মামাকাহিনি

সোহেল তাজের ভাগনে অপহৃত হয়েছিল। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ ভাগনেকে উদ্ধারের জন্য বিদেশ থেকে দেশে ছুটে এসেছেন এবং তাঁর ভাগনেকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এই ঘটনার পর ফেসবুক লাইভে সোহেল তাজের মুখে হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেছে।

এর দ্বারা আমরা কী বুঝতে পারলাম? মামা-ভাগনে যেখানে, আপদ নাই সেখানে।

কিন্তু সারা পৃথিবীতে আরও বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। বহু মানুষ অপহৃত হয়েছে। বহু মানুষ গুম হয়ে গেছে। তাদেরও নিশ্চয়ই মামা আছে। তবে সব মামা তো আর সোহেল তাজের মতো হয় না। কাজেই সব মামার নিখোঁজ ভাগনেরা ফিরে আসে না। মায়েরা কাঁদতেই থাকেন। তাঁদের চোখে ঘা হয়ে যায়।

বাংলা ভাষায় মামা শব্দের নানা মানে। ‘আরে মা-মা!’ এটা একটা সাম্প্রতিক বোল। আধুনিক ছেলেমেয়েরা এইভাবে বলে থাকে! এর মানে আমার জানা নেই। আমি আধুনিক নই।

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছিলাম, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মামা বলে ডাকেন। এটা বোধ হয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রচলিত। রিকশাওয়ালারাও কি তরুণ যাত্রীদের মামা ডাকেন?

চাঁদকে কেন মামা ডাকা হয়, তা-ও আমার জানা নেই। বোধ হয় মামাবাড়ির আবদার বলে যে কথাটা প্রচলিত আছে, তার সঙ্গে চাঁদকে মামা ডাকার সম্পর্ক আছে। মা শিশুকে শেখাচ্ছেন যে চাঁদ মায়ের ভাই, কাজেই তাকে যখন-তখন ডেকে আনা যায়।

বাংলাদেশে চাকরি পেতে মামার জোর লাগে। বিড়ালকে বলা হয় বাঘের মাসি। তবে শিয়ালকে বলা হয় বাঘের মামা।

মামা থাকা সব সময়েই লাভজনক। ভাগ্যিস, সোহেল তাজের ভাগনের মামার মতো একটা মামা ছিল।

তবু বলব, সোহেল তাজ যদি আরও শক্তিশালী মামা হতেন, হয়তো তাঁর ভাগনে অপহৃত হতোই না।

আবার এমন মামাও গল্পে পাওয়া যায়, যিনি তাঁর ভাগনের নাম ভুলে গিয়েছিলেন। মেলায় ভাগনে গেছে মামার হাত ধরে। ভিড়ের মধ্যে ভাগনে গেছে হারিয়ে। মামাও ভুলে গেছেন ভাগনের নাম। তখন মামা একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘আমি কার মামা, আমি কার মামা!’

মামা নিয়ে একটা ভয়ংকর ছড়া প্রচলিত আছে:
তাই তাই তাই, মামা বাড়ি যাই,
মামা দিল দুধ ভাত, পেট ভরে খাই
মামি এল লাঠি নিয়ে পালাই পালাই!

কোথাও কোথাও ছড়াটায় মামি দুধভাত খেতে দেন আর মামা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পে কিন্তু মামাটা ভালো, বিশ্বম্ভর বাবু। মামির চোখে ভাগনে ফটিক ছিল একটা অনাবশ্যক আপদ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:‘মামীর স্নেহহীন চক্ষে সে যে একটা দুর্গ্রহের মতো প্রতিভাত হইতেছে, এইটে ফটিকের সব চেয়ে বাজিত। মামী যদি দৈবাৎ তাহাকে কোনো-একটা কাজ করিতে বলিতেন তাহা হইলে সে মনের আনন্দে যতটা আবশ্যক তার চেয়ে বেশি কাজ করিয়া ফেলিত—অবশেষে মামী যখন তাহার উৎসাহ দমন করিয়া বলিতেন, “ঢের হয়েছে, ঢের হয়েছে। ওতে আর তোমায় হাত দিতে হবে না। এখন তুমি নিজের কাজে মন দাও গে। একটু পড়ো গে যাও।”—তখন তাহার মানসিক উন্নতির প্রতি মামীর এতটা যত্নবাহুল্য তাহার অত্যন্ত নিষ্ঠুর অবিচার বলিয়া মনে হইত।’

যা-ই হোক, গদ্যকার্টুনটি মামা আর মামির মধ্যে তুলনা করার জন্য নয়। বরং যারা হারিয়ে যায়, ফিরে আর আসে না, যারা অপহৃত হয়, গুম হয়, তাদের জন্য সোহেল তাজের মতো মামার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে আলোচনা করার জন্য।

মামার ইংরেজি আংকেল। আবার আংকেল জোকস হলো নিরামিষ কৌতুক, যা আংকেলরা খাবার টেবিলে বলেন, সবাই হাসে, কিন্তু সেই হাসি ভদ্রতার, কারণ আংকেল বলে নেন যে তিনি একটা কৌতুক বলছেন।

একটা আংকেল জোকস বলি।

একটা ছেলে তার মামাকে চিঠি লিখছে। প্রিয় মামা, মায়ের আবার সন্তান হয়েছে। সে ছেলে না মেয়ে, আমি এখনো জানি না। তাই বলতে পারছি না, তুমি কি আবার মামা হলে নাকি খালা হলে!

গুম নিয়ে রসিকতা করতে ইচ্ছা করছে না। বহু বছর আগে প্রথম আলোয় ছাপা হয়েছিল গুমের কাহিনি, তাতে নিখোঁজ একজনের আত্মীয় বলছিলেন, এর চেয়ে ক্রসফায়ার ভালো, অন্তত লাশ পাওয়া যায়। অন্তত মৃতের উত্তরাধিকারীরা সম্পত্তি বুঝে পান। গুম মানুষদের আত্মীয়স্বজন তো কিছুই পান না, শুধু অনন্ত প্রতীক্ষার দুঃখকষ্ট ছাড়া!

বিল গেটস নাকি বলেছেন, আপনি যদি গরিব হয়ে জন্মগ্রহণ করেন, সেটা আপনার অপরাধ না, কিন্তু যদি আপনি গরিব হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, সেটা আপনার ব্যর্থতা।

আমরা বলব, আপনি যদি মামা ছাড়া জন্মগ্রহণ করেন, সেটা আপনার অপরাধ নয়, কিন্তু আপনি যদি মামা ছাড়া মৃত্যুবরণ করেন, এটা আপনারই ব্যর্থতা। কাজেই সবাই মামার মতো মামা জোগাড় করে ফেলুন।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক