সময়োপযোগী রাজনীতি ও সংগঠন প্রয়োজন

বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সবচেয়ে পুরোনো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ও কার্যক্রমে আম জনগণ উপেক্ষিত হওয়ায় তাদের পাল্টা সংগঠন হিসেবেই ১৯৪৯ সালে এ দলের জন্ম। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী জাগরণের সূচনায় এ দল তার নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়, কেননা শব্দটি একটি সম্প্রদায়ের পরিচয়-বাচক। জনগণের মুসলিম লীগ থেকে জনগণের দল বা আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়। দলটি পশ্চিমঘেঁষা ডানপন্থী ক্ষমতার রাজনীতির ধারা থেকে ক্রমে সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির দিকে ঝুঁকেছিল। এসব বিষয় কমবেশি সবারই জানা। শুধু এ কারণেই এ প্রসঙ্গ তোলা যে বঙ্গবন্ধু বাস্তবতা বুঝে দলের নীতি ও কাঠামোয় সময়োচিত পরিবর্তন আনতে দ্বিধা করেননি।

স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু প্রশ্নাতীতভাবেই জনগণের নায়ক, আর আওয়ামী লীগ প্রধান রাজনৈতিক দল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সরকারি কোষাগার শূন্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও দেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকি সরকারের চাকরি করা ও সহায়তা গ্রহণের প্রশ্নে বিভক্তিও ছিল বাস্তব। কোটি শরণার্থী ও পাকিস্তান-প্রত্যাগতদের পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জও ছিল প্রকট। পরাজিত পাকিস্তানসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দোসরদের সক্রিয় বিরুদ্ধতা এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী তরুণদের একটি বড় অংশের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনমনীয় তৎপরতা ছিল সরকার ও আওয়ামী লীগের সামনে একটা বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৎপর ছিল। কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়টিই তো রচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তার ফল শুধু স্বাধীন রাষ্ট্র, পতাকা, জাতীয় সংগীত বা একটি নিজস্ব সরকার অর্জনে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার সবচেয়ে বড় ফসল ছিল জাতীয় ঐক্য, যার প্রকাশ ঘটেছিল প্রবাসী সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা কাউন্সিলে। সেদিন মুষ্টিমেয় দেশদ্রোহী ছাড়া জনগণের সত্যই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের সক্রিয় সাহসী অংশগ্রহণ ও বিপুল ত্যাগের বিনিময়েই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা-উত্তর নবীন রাষ্ট্রটিতে প্রয়োজন ছিল ঐক্য ধরে রেখে জনগণের অংশগ্রহণমূলক পুনর্গঠন কাজের পাশাপাশি একই চেতনায় রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদান। তখন মাঠপর্যায়ে বহু কাজ ছিল—বিধ্বস্ত বাড়িঘর-সেতু-কালভার্ট নির্মাণ, খাদ্যোৎপাদন, শিক্ষা-জনস্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রের কথা বলা যায়। এককথায় অল্প কিছু দেশদ্রোহী ব্যতীত বাকি সবার অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে পুনর্গঠনের কর্মযজ্ঞ হতে পারত তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও কর্মের প্রধান ধারা। কিন্তু ঠিক এভাবে ভাবা হয়নি। সরকারের মাধ্যমেই প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কাজ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে থেকেও রাজনৈতিক কর্মীরা দেশ গঠনের কাজে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেননি। আওয়ামী লীগের অল্প কিছু মানুষ সরকারের নানা দায়িত্বে যুক্ত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু সংগঠনের বিপুল নেতা-কর্মী সেভাবে দেশ গঠনের রাজনীতির দিশা বা নির্দেশনা পাননি। এ অবস্থায় তাঁদের একটি বড় অংশ স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও নিজ দলীয় সরকারের পরিচয় ব্যক্তিস্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন। তা বলে রাজনীতির মাঠে শূন্যতা থাকেনি, জাসদের ছাতার তলায় যেমন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী তরুণেরা সমবেত হয়েছিল, তেমনি সরকারের বিরোধিতার সুযোগ কাজে লাগাতে স্বাধীনতাবিরোধীরাও জড়ো হয়েছিল। সরকারের জন্য এ কঠিন পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ভুল করেনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসরেরা। পরবর্তী ঘটনাবলি সবার জানা আছে।

পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রকৃত মূল্য দেওয়া হয়নি, জিয়াউর রহমান তো রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেওয়ার ব্রত নিয়েছিলেন। দেখা যাচ্ছে ক্রমেই দেশের সব সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। এখন যেন এর চরম রূপ আমরা দেখছি। মনে রাখা দরকার, আমলাতন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব ও অতি শক্তিশালী ভূমিকা গণতান্ত্রিক বিকাশের অনুকূল নয়।

ওপরে একটি প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি। আমার মূল উদ্দেশ্য বর্তমান নিয়ে দুটি কথা বলা। বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির চরম বিকাশের ফলে এবং বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির কল্যাণে বৈষয়িক উন্নতির ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিপরীতে মানুষেরই চরম অবিমৃশ্যকারিতায় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে মানবজাতি ও এই গ্রহের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে ব্যক্তিক ও সামষ্টিকভাবে মানবজীবনে যে রূপান্তর ঘটে চলেছে এবং যেসব নতুন চ্যালেঞ্জ মাথাচাড়া দিচ্ছে, তা বিবেচনায় নিয়েই তো এখনকার রাজনীতি ও সংগঠন ঢেলে সাজাতে হবে। কিন্তু তেমন কোনো আলামত আমরা দেখছি না। তামাদি রাজনীতি ক্রমেই গুরুত্ব হারালেও সংগঠন চলছে একইভাবে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দুই বড় দল অনেক অঙ্গ সংগঠন তৈরি করেছিল। আজ এগুলো জীবন্মৃত, কমিটিগুলোর অধিকাংশই তামাদি, অসম্পূর্ণ। শুধু কিছু মানুষ সভাপতি-সম্পাদক বা কর্মকর্তার পরিচয় বহন করেন। মূল দল, ধরা যাক আওয়ামী লীগেরই তো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রম ইত্যাদি সম্পাদক আছেন, তবে কেনই–বা নিজস্ব শিক্ষক সংগঠন, চিকিৎসক সংগঠন প্রয়োজন? কেনই–বা থাকবে পৃথক স্বেচ্ছাসেবক লীগ (সব রাজনৈতিক কর্মীই তো স্বেচ্ছাসেবী), তাঁতী লীগ, স্বাচিপ ইত্যাদি! যাঁরা রাজনীতিতে আগ্রহী, তাঁরা মূল দলে যোগ দেবেন আর কেউ যদি পেশাজীবী সংগঠনে থাকতে চান তাহলে শিক্ষক সমিতি, বিএমএ বা আইইবির মতো সংগঠন করবেন। কিন্তু এখন নানা মতলবে, প্রধানত সরকারের কৃপাপ্রত্যাশী হয়ে বঙ্গবন্ধু বা বঙ্গবন্ধু পরিবারের কোনো সদস্যের নামে কিংবা জয় বাংলার মতো মুক্তিযুদ্ধের ভাবাবেগ বহনকারী শব্দ ব্যবহার করে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। এ ধরনের সাংগঠনিক স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্য মূল সংগঠনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ও রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রকাশ ঘটায়। এত সব অঙ্গসংগঠন যে বাহুল্য হয়ে পড়েছে, তা বোঝা যায় দীর্ঘদিন এগুলোর কর্মকাণ্ড বা সম্মেলন না হওয়া, এগুলো থেকে জাতীয় প্রেক্ষাপটে কোনো নতুন কণ্ঠস্বর বা চেহারার আবির্ভাব না ঘটায়।

ছাত্রসংগঠনের দিকে তাকালেও স্থবিরতা ও অবক্ষয়ই দেখা যায়। সম্প্রতি ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন নিয়ে উভয় সংগঠনে যে ক্ষোভ-প্রতিবাদ দেখা গেছে, তার স্বচ্ছ, সুষ্ঠু সমাধান কোনো সংগঠনই দিতে পারেনি। ছাত্রলীগের সংগ্রামী ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও তারাও ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের (অধুনা নিষ্ক্রিয়) মতো ক্যাম্পাসে দখলদারি কায়েমকেই রাজনীতি মনে করছে। অথচ এভাবে সাধারণ ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্বের চাপ দেওয়া যায়, কোনো প্রভাব তৈরি করা যায় না। সাম্প্রতিক কালের ছাত্র-তরুণদের তিনটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন গণজাগরণ মঞ্চ, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সংগঠিত করেছে নির্দলীয় ছাত্র-তরুণেরা। দখলদারত্বে অভ্যস্ত ছাত্রসংগঠন এগুলোর সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি, বরং প্রায়ই বিরুদ্ধতা করেছে। এভাবে একটি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ছাত্রসংগঠন গণচেতনার বিরোধী অবস্থানে চলে যাচ্ছে। তাতে বোঝা যায়, সময়ের রাজনীতি বা করণীয় সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই।

আমরা জাতি হিসেবে জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়েছি। শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো প্রয়োজন এবং সরকার তাতে হাতও দিয়েছে। দেশে শিক্ষাবিপ্লব ঘটাতে হবে। তরুণদের জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের সংকটসহ বিপথগামিতার নানা পথও খুলে যাচ্ছে। শিশুরা আনন্দময় শৈশব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বত্র যোগ্য স্বেচ্ছাসেবী দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটানোর কাজও তো কম নয়। কত ইস্যু, কত বিষয়—সব ছেড়ে শুধু টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তার যদি গুরুত্ব পায়, তবে সে সংগঠনের অবক্ষয়ই বিধিলিপি। অবক্ষয়ের সঙ্গে ক্ষমতা ও বিত্ত যুক্ত হলে তা অন্য মত, স্বাধীন ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। পরিণামে না নিজের, না অন্যের কল্যাণ করা সম্ভব হয়। শুধু সংকটের মধ্যে ঘুরপাক খেতে হয়। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা হলো সংগঠনকে তার সময়ের রাজনীতি খুঁজে নিতে হবে, সে অনুযায়ী দলকে চালাতে ও কাজ করতে হবে।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক