শিল্পায়ন অটোমেশনে, না পরম্পরায়?

গত ৩০ মে ২০১৯ খ্রি. তারিখে ‘বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা কমেছে’ শীর্ষক বিবিএসের একটি জরিপ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়। সিদ্ধান্তটি টানা হয়েছে শ্রমিকসংখ্যার মানদণ্ডে। ১০ থেকে ২৪ জন শ্রমিক যে শিল্পে কাজ করে, তা অতিক্ষুদ্র শিল্প, ২৫-৯৯ জনেরটি ক্ষুদ্র শিল্প, ১০০-১৪৯ জনেরটি মাঝারি ও ২৫০+ জনেরটি বৃহৎ শিল্প ধরা হয়েছে। এই জরিপে জানা যায়, গত ৬ বছরে বৃহৎ শিল্প ৩ হাজার ৬৩৯টি থেকে কমে ৩ হাজার ৩১টি হয়েছে ও মাঝারি শিল্প অর্ধেকের বেশি কমে ৬ হাজার ১০৩ থেকে ৩ হাজার ১৪টি হয়েছে। সেখানে ক্ষুদ্র শিল্প বেড়ে ১৫ হাজার ৬৬৬টি থেকে ২৩ হাজার ৫৫৭টি হয়েছে। আর অতিক্ষুদ্র শিল্প ১৭ হাজার ৩৮৪টি থেকে কমে ১৬ হাজার ৬৮৯টি হয়েছে। এই জরিপ সম্পর্কে এ কে খান গ্রুপের পরিচালক ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেছে; কিন্তু বিনিয়োগ হচ্ছে। সে কারণে শুধু কারখানার শ্রমিকের সংখ্যা দিয়ে শিল্প খাতের প্রকৃত চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়।

২০১৬ সালে আইএলওর একটি প্রতিবেদনেও এই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল, ‘বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে পোশাক–সংশ্লিষ্ট খাতে ৮০ ভাগের বেশি কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে।’ একই তথ্য উঠে এসেছে ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির ওয়াল স্ট্রিট জার্নালেও। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানায় বুননের সবটুকু কাজ জার্মানি ও স্পেনের বিভিন্ন স্তরের মেশিনগুলো করছে। আগে দৈনিক ১০ ঘণ্টায় ৫ শতাধিক শ্রমিক যে কাজ করত, সেখানে ১৭৩ রকমের স্বয়ংক্রিয় মেশিন সেই কাজ করছে। শুধু কয়েকজন শ্রমিক রয়েছে মেশিনগুলো পরিষ্কার করার কাজে। মজুত বেকাররাই যেখানে বঙ্গোপসাগর আর ভূমধ্যসাগরের ডুবছে, সেখানে পোশাক কারখানায় কর্মরতরা ৮০ ভাগ যোগ দিলে মহাসাগরে মরা ছাড়া পথ কোথায়?

কর্মসংস্থানের ওপর অটোমেশনের প্রভাব কী হতে পারে, সে সম্পর্কিত ১৮টি প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে কেমব্রিজ–ভিত্তিক এমআইটি টেক রিভিউ জানিয়েছে, ‘বিশ্বজুড়ে চলমান ২০০ কোটি কর্মসংস্থানের ১০০ কোটিই বিলুপ্ত হবে ২০৩০ সালের ভেতর।’ অর্থনীতিবিদ কার্ল ফ্রে ও যন্ত্রশিক্ষাবিষয়ক গবেষক মাইকেল অসবর্ন ২০১৩ সালে ‘কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে অক্সফোর্ডের একটি গবেষণাপত্রে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ২০৩৩ সালের মধ্যে ৪৭ শতাংশ কর্মসংস্থান বিলুপ্ত হবে। অর্থাৎ চাকরি হারানোর দলকে একেবারে ভিন্ন পেশা গ্রহণ করতে হবে, অবশ্য যদি তাদের সেই যোগ্যতা থাকে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, ১ হাজার শ্রমিকের একটি কারখানায় শ্রমিকদের পাশাপাশি একটি রোবট নিয়োগ দেওয়ার পর দেখা যায়, আগের তুলনায় বছরে শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ হারে শ্রমিক হ্রাস পায়, পাশাপাশি মজুরি ব্যয় বাবদ কমে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। তাহলে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের আর ভাত নেই।

২.
সাঁইজির একটা গান আছে, ‘লালন মলো জল পিপাসায়/ থাকতে নদী পদ্মা’, কিংবা রবীন্দ্রনাথের—‘দুয়ারে এঁকেছি রক্ত রেখায় পদ্ম আসন/ সে তোমারে কিছু বলে?’ সম্ভবত বলে।

নবাবি আমলে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ না হয়েও কৃষি উদ্বৃত্তের দেশ ছিল। নিজ জনসংখ্যার ৩ গুণ মানুষকে সে খাওয়াত। বস্ত্র পরাত সারা দুনিয়াকে। পলাশীর পর ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো বছর বছর গণহত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে কৃষিনির্ভর দেশে পরিণত করা হয়। ১৭৭৫ সালের কয়েকটি অঞ্চলের সমীক্ষাতেও দেখা গেছে, মাত্র ৩০-৪০ ভাগ মানুষ কৃষিকাজে নিযুক্ত, বাকিরা ছিল কারিগরসহ অন্যান্য পেশার। এমনকি ১৮৯১ সালেও শিবপুরের জরিপে ৪১৯টি হিন্দু পরিবারের ১৫ শতাংশ কারিগর, ২২ শতাংশ জেলে, ২৫ শতাংশ কৃষক ও বাকিরা অন্যান্য। মানে এই ৩০-৪০ ভাগ কৃষকই ছিল শিল্পের কাঁচামালেরও জোগানদার।

তাঁতশিল্পের কথা নতুন করে বলার নেই। পৃথিবীতে এ এক অনন্য ঘটনা ছিল, একটি মাত্র পণ্য এত ব্যাপক মাত্রায় তৈরি হতো যে সারা দুনিয়ার বাজার দখল করেছিল। পলাশীর আগের দুই দশকে প্রতিবছর ৬০ লাখ টাকার চিনি রপ্তানি হতো। এমন একটি শিল্পোন্নত দেশ ছিল যে নুন থেকে শুরা, তামাক থেকে চাল আর লোহা থেকে কাগজ—সবকিছুই রপ্তানি হতো। নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে হাজার হাজার বছরের কারিগরদের জ্ঞান, দক্ষতা, দেশীয় বিকেন্দ্রীভূত কারিগরি বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ প্রযুক্তি ও স্থানীয় বাজারভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে আমাদের নারী-পুরুষেরা এসব তৈরি করত। এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিশাল সেচব্যবস্থা, শাঁখারীদের শাঁখের করাত, মসলিনের তাঁত, চাষের যন্ত্র, মাছ ধরার জাল, বীজ সংরক্ষণ, শস্য ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা, জাহাজ নির্মাণশিল্প, তথা মেশিন তৈরির যন্ত্র। আর এই উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদকদের নিয়ন্ত্রণে থাকত প্রযুক্তির প্রয়োগ ও জ্ঞান। যে প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উৎপাদন হচ্ছে, তা বড় পুঁজির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত কি না অর্থাৎ কাজ করতে করতে প্রযুক্তি বিকল হয়ে গেলে সে নিজে বা প্রতিবেশীর কাছ থেকে সারিয়ে নিতে পারে কি না। আর সে কারণেই বাংলার, তথা ভারতীয় জ্ঞানচর্চা ছিল শ্রুতিনির্ভর ও হাতেনাতে; যা সহজতম প্রক্রিয়ায় সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত, বিকশিত হতো। আর এ কারণেই ইউরোপীয় তাঁতিরা ছিল দাস আর ভারতীয় তাঁতিরা ছিল স্বরাট। আর বাংলা ছিল বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্র।

যে ইউরোপ গত কয়েক শ বছরে নিজ ভূখণ্ডে ও উপনিবেশে চাষি, পশুচারণকারী, তাঁতি, কারিগরদের ধ্বংস করে শ্রমিক ও দাস বানিয়েছে; সেখানে বৃহৎ শিল্পে মানুষ আজ অতিরিক্ত আর ফেলনা। যেখানে উৎপাদন হবে শ্রমিক থাকবে না, চাষ হবে কিন্তু চাষা থাকবে না। মানুষ নয়, রোবটই নির্ধারক। কিন্তু যে উৎপাদন ব্যবস্থায় জ্ঞান হচ্ছে সামাজিক, উৎপাদন হচ্ছে জীবন ও প্রকৃতি সাপেক্ষে, সেখানে অটোমেশন সহজেই সব স্তরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই। ক্ষুদ্র শিল্পের বৃদ্ধিতে তারই ইঙ্গিত। বড় কারখানায় অটোমেশনের কারণে বেকারত্ব বিভীষিকা আকারে দেখা দেওয়ার আগেই তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে গুরুত্ব দিতে হবে।

লেখক: সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]