ধন্যবাদ, মি. নির্বাচন কমিশন

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটারদের বাপের নাম ভুলিয়ে দিতে না পারলেও তাঁদের যে ভোটকেন্দ্রবিমুখ করতে পেরেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। কেননা, ১৯৩৭ সাল (১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে সেটিই ছিল প্রথম সাধারণ নির্বাচন) থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত ঘটন-অঘটন ঘটেছে, তার পেছনে ছিল নির্বাচন। নির্বাচন দিয়ে এ দেশের মানুষ একসময় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল। আবার নির্বাচনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করেছিল। এখন সম্ভবত ‘সব পেয়েছির দেশে’ আমাদের আর পাওয়ার কিছু বাকি নেই। ফলে ইসি যদি জনগণকে ভোটবিমুখ করে থাকে, তাহলে হক কাজই করেছে। ভোট নিয়ে অতীতে যে কত মারামারি, লাঠালাঠি; কত গুম-খুনের ঘটনা ঘটেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

কিন্তু সমস্যা হলো মি. নির্বাচন কমিশনের। যদি মানুষ সত্যি সত্যি নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়ে, জনপ্রতিনিধি বাছাই করতে আর ভোটাভুটির প্রয়োজন না থাকে, তাহলে উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় ইসি পোষারও কোনো মানে হয় না। অতএব, মানুষকে ভোটকেন্দ্রে টানতে না পারলেও কে এম নূরুল হুদা ও তাঁর সহযোগীদের চাকরি রক্ষার জন্য হলেও নির্বাচনী মহড়া চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে, তা মহড়াই বটে। যুদ্ধের মহড়া যেমন আসল যুদ্ধ নয়, নির্বাচনের মহড়াও আসল নির্বাচন নয়।

যে দেশে ৯০ বছরের বৃদ্ধ অন্যের কাঁধে চড়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি দিয়ে আসেন, সে দেশের মানুষ ভোটবিমুখ হবে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। গেল শতকের আশি ও নব্বই দশকে দেখতাম কৃষক সাদেক ও সিলেটের সয়ফুর (সাবেক অর্থমন্ত্রী নন) ভোট এলেই দাঁড়িয়ে যেতেন; তা হোক ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরাসরি ভোটে হতো। গত বছর সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দেখেছি বহু প্রবাসী বাংলাদেশি শুধু ভোট দেওয়ার জন্য দেশে এসেছেন। ভোট নাগরিকের পবিত্র আমানত। কিন্তু এই আমানত রক্ষার দায়িত্ব যে ইসির, তারা সেটি রক্ষা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ২০০৮ সালে, ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। ১৯৯৬ সালের (১২ জুন) নির্বাচনে এই হার ছিল ৭৪ দশমিক ৯৬। ২০০১ সালে ৭৫ দশমিক ৫৯। এসব তথ্য কেউ চ্যালেঞ্জ করেননি। কিন্তু গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে ইসি যে দাবি করেছে, তা অবিশ্বাস্য। মানুষ যা চোখে দেখেছে, ইসি বলেছে তার উল্টো। যেখানে বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে ভোটার পাওয়া যায়নি, সেখানে ৮০ শতাংশ ভোট কীভাবে পড়ল? দুর্মুখেরা বলেন, এসব ভোট দিনে পড়েনি, রাতে পড়েছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে। বাংলাদেশের মানুষ লোকচক্ষুর অন্তরালের ভোটের জন্য সংগ্রাম করেনি, জীবন দেয়নি।

বর্তমান ইসির আমলেই গত বছর রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৮ শতাংশ, সিলেটে ৭৫ শতাংশ। সেই সংখ্যাটা কমিশন ঢাকা উত্তরে নামিয়ে এনেছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। অর্ধেকের কম। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৪৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে ভোট পড়েছিল ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর তৃতীয় ধাপে ভোট পড়েছে ৪১ দশমিক ৪১ শতাংশ বা ৪১ শতাংশ। কিন্তু চতুর্থ ধাপে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আর সর্বশেষ পঞ্চম দফার উপজেলা নির্বাচনে ৩৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তারা অর্ধেক মানুষকে নির্বাচনবিমুখ করতে পেরেছে। কমিশন এই ধারা অব্যাহত রাখলে ভোটকেন্দ্র ভোটারশূন্য করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

সে ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে তা হলো এক. প্রার্থীকে আর ভোটের জন্য ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধরনা দিতে হবে না। দুই. প্রচারের জন্য প্রার্থীকে কোনো অর্থ খরচ করতে হবে না। তিন. ভোটের দিন কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে না। চার. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রতি কেন্দ্রে পুলিশ র‌্যাব, বিজিবি, আনসার ইত্যাদি মোতায়েন করতে হবে না। পাঁচ. নির্বাচনের আগে বিরোধীদলীয় প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে না। ভোট গ্রহণের আগে প্রত্যেক প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের নাম ইসিতে জমা দিতে হয়। গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখা গেছে, সেই তালিকা ধরে পুলিশ পোলিং এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়েছে, নেতা-কর্মীদের আটক করেছে।

যেদিন পঞ্চম দফা উপজেলা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হলো, সেদিন কে এম নূরুল হুদা বগুড়া উপনির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তৃতা দিয়েছেন। তিনি ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে সবাইকে ভোটরক্ষা করতে বলেছেন। তাঁর এ কথা শুনে হাসি সংবরণ করা কঠিন। কেননা যে ইসি একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য করতে পারেনি, সেই ইসি প্রধান কিনা কথায় কথায় সুষ্ঠু নির্বাচনের সবক দিচ্ছেন। ভবিষ্যতে জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচনেই ইভিএম চালুর ঘোষণা দিয়ে সিইসি বলেছেন, ‘ইভিএমে ভোট গ্রহণ যেমন সহজ, তেমনি ভোট গ্রহণের এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে ফল পাওয়া যায়।’ তত দিনে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ইভিএম ব্যবহার করার মতো মানুষ পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।

সিইসি নূরুল হুদা যেদিন বগুড়ায় এসব কথাবার্তা বলেছেন, সেদিনই আরেক কমিশনার মাহবুব তালুকদার ঢাকায় নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন। তাঁর ভাষায়, ‘এবার উপজেলা নির্বাচনে সবচেয়ে আশঙ্কার দিক হচ্ছে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা। নির্বাচনবিমুখতা জাতিকে গভীর খাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ। এ অবস্থা কখনো কাম্য হতে পারে না।’

মাহবুব তালুকদার গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চান না বলে দেশবাসীকে জানিয়েছেন। কিন্তু এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে মানুষকে ভোটবিমুখ করে তুলেছে, তাতে গণতন্ত্রের অন্তিমযাত্রায়ই একদিন সবাইকে শামিল হতে হবে।

আসলে বাংলাদেশের মানুষ মোটেই ভোটবিমুখ হয়নি। ইসি নির্বাচনের পূর্বশর্তগুলো পূরণ করতে পারেনি বলেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একসময় পাড়ার মাস্তানেরা বলত, ‘চাচা, আপনি তো অমুক মার্কায়ই ভোট দেবেন। তবে আর কষ্ট করে কেন কেন্দ্রে যাবেন? ধরে নিন আপনার ভোটটি দেওয়া হয়ে গেছে।’ বর্তমান ইসি আর কিছু না পারুক সেই ধরে নিন পরিবেশ নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১২টি নির্বাচন কমিশন ও ১২ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পেয়েছে। প্রথম সিইসি ছিলেন মোহাম্মদ ইদ্রিস। আর সর্বশেষ কে এম নূরুল হুদা। মাঝখানে আরও ১০ জন। তবে তাঁদের মধ্যে দুটি ধারা। একটি হলো যারা জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন করতে পেরেছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই তালিকায় বিচারপতি রউফ, মোহাম্মদ আবু হেনা, এম এ সাঈদ ও এ টি এম শামসুল হুদার নাম আসবে। আরেকটি হলো যাঁরা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারেননি। এই ধারায় আছেন বিচারপতি নুরুল ইসলাম, এ টি এম মসউদ, সুলতান হোসেন খান, এ কে এম যাকারিয়া, রকিবউদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

এখন দেশবাসীই বিচার করবেন কে এম নূরুল হুদা ও তাঁর সহযোগীদের নাম কোন সারিতে থাকবে। বাংলাদেশে সবচেয়ে নিন্দিত সিইসি বিচারপতি আজিজ কোনো জাতীয় নির্বাচন করতে পারেননি। পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। রকিব কমিশন ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন করেছিল। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নূরুল হুদা কমিশন যে নির্বাচনটি করল, সেটি অংশগ্রহণমূলক হলেও সুষ্ঠু হয়েছে সে কথা কেউ বলবে না। সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে ভোটবিমুখতা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র।তাই আবারও ধন্যবাদ মি. নির্বাচন কমিশন।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]