ভূমিহীন বলে দুঃখ নেই

শেষ জ্যৈষ্ঠের দুপুরবেলা উত্তরবঙ্গের কাঁঠাল–পাকানো গরমে প্রাণ যায়–যায়, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা সদরে বাস থেকে নেমে খাঁ খাঁ রোদে ঝলসে গেল চোখ। চলন্ত বাসে যাত্রীদের ভিড় সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে বাতাসের পরশ পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু রোদে প্রায়–গলন্ত পিচের মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হলো পৃথিবী বায়ুশূন্য হয়ে গেছে। গাছগুলোর পাতারা একদম স্থির, মহাসড়কের ওপর দিয়ে বয়ে আসছে তাপের ঢেউ।

চারদিক নীরব নির্জন, রোদের তাড়া খেয়ে বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের ছায়ার আশ্রয়ে গেছে সবাই। অবশ্য সড়কের দুই ধারের অধিকাংশ দোকানপাটই বন্ধ; অল্প যে কয়েকটা খোলা আছে, সেগুলোর দোকানিরা ক্রেতার অভাবে হাই তুলছে, কেউ কেউ তন্দ্রায় ঢুলছে। একটা দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনে ডানে–বঁায়ে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, সড়কের উল্টো পাশে বেশ খানিকটা দূরে এক ছায়াচ্ছন্ন বটগাছ; তার নিচে ছোট ছোট তিনটা দোকান। দুটোই বন্ধ, যেটা খোলা আছে, সেটার মালিকের আসনে কেউ নেই। পাশে এক লম্বা বেঞ্চে আয়েশ করে আধশোয়া হয়ে ধূমপান করছে এক লোক। বটের ছায়ার তৃষ্ণায় আর লোকটার সঙ্গে গল্প করার লোভে এগিয়ে গেলাম সেদিকে।

আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালে লোকটা আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসল; পুড়ে শেষ হয়ে আসা সিগারেটে শেষ টান দিয়ে জ্বলন্ত ফিল্টারটা একদিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, ‘কী লিবেন?’

আমি বললাম, কিছু কিনতে আসিনি, ছায়ায় একটু বসতে চাই। সে বেঞ্চের এক পাশে সরে গিয়ে সাদরে বলল, ‘বসেন, ভাই।’

আমি তার পাশে বসে পানির বোতলের ছিপি খুলে দুই চুমুক দিয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। ঘন–তামাটে মুখমণ্ডলটি সতেজ। মাথায় টাক, গোঁফ ছঁাটা, অনেকটা ফ্রেঞ্চ–কাট দাড়িতে পাক ধরেছে। কিন্তু দাড়ির পাকা চুলগুলোর রুপালি রং ঢাকা পড়েছে মেহেদির গাঢ়
খয়েরি রঙে।

‘দোকানদার নামাজ পড়বা গেছে।’ বলল সে, আমি কিছু বলার আগেই। বুঝলাম যে সে দোকানটা পাহারা দিচ্ছে। বললাম, ‘আপনি কী করেন?’ সে বলল, ‘ঘরবাড়ি বানাই।’

‘মাটির ঘরবাড়ি?’

লোকটা হেসে উঠল, ‘কী কন, ভাই! এখন কেউ মাটি দিয়ে ঘরবাড়ি বানায়? হামি রাজমিস্ত্রি।’

‘জমিজমা নাই?’

‘ছটাক খানেকও নাই,’ হাসতে হাসতেই বলল সে।

‘ও!’

আমার এই ‘ও’ ধ্বনিতে সম্ভবত একটু করুণা প্রকাশ পেল। সেটা বোধ হয় তার ভালো লাগল না। বলল, ‘জমি থ্যাকে লাভ কী? ধানের তো দাম নাই। ব্যাবাক জমিআলারা ধানের বাম্পার ফলন লিয়ে এখন বসে বসে কান্দিচ্ছে।’

তারপর সে আঙুল দিয়ে ইশারা করে তাকাতে বলল একটা মোটরসাইকেলের দিকে, একটু দূরেই সেটা দাঁড়িয়ে আছে।

‘ওই গাড়িডা হামার। হুন্ডা সিডি হান্ডেড,’ হাসিমুখে বেশ গর্বের সঙ্গে বলল সে, ‘এক ছাদ ঢালাইয়ের কাম শ্যাষ করলাম। বিল হোবে এক লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার, হামার লাভই থাকপে পঞ্চাশ হাজারের মতন। হামার মাটি নাই তে কী হছে, ভাই?’

উত্তরবঙ্গের লোকজন জমিকে মাটিও বলে। জানতাম, তারা মনে করে যার মাটি নেই, তার মতো দুঃখী–দুর্ভাগা আর হয় না। কিন্তু আজিজার রহমান নামের চল্লিশ বছর বয়সী এই লোকের সঙ্গে গল্প করে জানলাম, এখন জমির মালিকেরাই বরং দুঃখী, কারণ তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধারকর্জ করে ধান ফলিয়ে লোকসান গোনে, তাদের দারিদ্র্য ঘোচে না।

রাজমিস্ত্রি আজিজ আমাকে বলে, ‘বিশ বিঘা মাটির মালিকও হামার সাথে পারবে না।’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো অনুভব করে যে এভাবে বলা ঠিক হলো না, তাই নিজের ব্যবহার শুধরে নেওয়ার চেষ্টায় বলে, ‘ও ভাই, মনে করেন না হামি ফুটানি করিচ্ছি। ফুটানি লয় ভাই, আল্লার রহমতের কথা কচ্ছি। আল্লা হামাক দিছে, ভাই। মাটি নাই বলে হামার কোনো দুক্কু নাই।’

কিন্তু তার জীবনে দুঃখকষ্ট ছিল। সে আমাকে বলে, ‘বিরাট হিসটিরি, ভাই। হামার মায়ের বাপের বাড়ি আছেল গাইবান্ধা। বিয়া হছিল, পাঁচ বেটা হওয়ার পর মায়ের ওই স্বামী মরে যায়। মা পাঁচ বেটা লিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। ভিক্ষা করতে করতে মাত্রাই–বিয়ালার দিকে চলে আসে। বিয়ালার এক গৃহস্থ মায়ের অবস্থা দেখে দয়া করে বিয়া করে। তার আরেকটা বউ আছিল, তারও পাঁচ বেটা। দুই বউ, দশ বেটা। তারপর হামার জন্ম হলো। তারপর মায়ের এই স্বামীও মারা গেল। দেখেন, হামার মায়ের কপালডা দেখেন! সতিন বার করে দিল, মায়ের আবার ভিক্ষা করা আরম্ভ হলো...।’

মা ভিক্ষা করেও আজিজকে পড়াতে চেয়েছিলেন, ভর্তি করিয়েছিলেন মাদ্রাসায়। আজিজ ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পরে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়, গ্রামের গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি কামলা খেটে বড় হয়। একপর্যায়ে এই কাজে তার গ্লানিবোধ শুরু হয়। তখন সে দরজির কাজ শেখে।

‘পাঁচ বছর কাপড় সিলাইয়ে কাম করিছি, ভাই। দিন চলেনি। ভাতের কষ্ট। একদিন সিলাইয়ের কাম ছ্যাড়ে দিলাম, রাজমিস্ত্রির জোগালি হলাম। তাড়াতাড়ি কাম শিখে গেলাম। বেশি দিন জোগালি দেওয়া লাগেনি, ফুল মিস্ত্রিই হয়া গেলাম। এখন আল্লার রহমতে হেড মিস্ত্রি।’

‘বিয়ে করেছেন নিশ্চয়ই?’

আমার প্রশ্নের জবাবে আজিজ তার ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দেখিয়ে হাসিমুখে বলে, ‘দুই বেটির বাপ হামি। বড় বেটি ম্যাট্রিক পাস করিছে। প্রধানমন্ত্রীর হাত থ্যাকে প্রাইজ লিছে, রাষ্ট্রপতির হাত থ্যাকেও প্রাইজ লিছে। রংপুর সিটি গবমেন্ট কলেজে চান্স প্যাছে। ছোট বেটি এইটে পড়ে। সেও লেখাপড়াত খুব ভালো। বড় বেটিক হামি ডাক্তার বানামো, ছোট বেটিক ব্যারিস্টারি পড়ামো।’

‘আপনি অন্য লোকজনের ঘরবাড়ি বানিয়ে দেন, নিজের বাড়িও করেছেন নিশ্চয়ই?’

‘থাকার মতো বাড়ি করিছি ভাই, টিনের ছাদ। পাকা বাড়ি হামার লাগবে না। এখন হামার সব চিন্তা দুই বেটিক লিয়ে। আয়রোজগার আল্লা দিলে যা হোবে, সবই ওরগের লেখাপড়ার পিছে খরচ করমো।’

‘দুই–চার বিঘা জমি কেনার শখ হয় না আপনার?’

‘না ভাই, জমি কিনার শখ নাই। বড় বেটিক যদি ডাক্তার বানাবা পারি, মানষের উপকার হোবে। কত গরিব মানুষ অসুখ হলে চিকিসসা পায় না। মা মারা গেছে, মা হামাক বলত, বাবা, পারলে মানষের উপকার করিস, তালে জীবনে কোনো দিন জুতা খোলা লাগবে না। আর যদি মানষের সাথে অন্যায় করিস, তালে একদিন ফকির হয়া যাবু।’

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]