মুরসির সঙ্গে নিষ্ঠুরতা

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

মোহাম্মদ মুরসির মিসরের প্রথম বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা ছিল না। তাঁর প্রেসিডেন্সির মেয়াদকালে, যা মাত্র এক বছর টিকেছিল, মিসরীয়রা কৌতুকভরে তাকে ‘অতিরিক্ত টায়ার’ বলে উল্লেখ করতেন। কারণ, মিসরের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছিল। কিন্তু কৌশলগত কারণে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করার পর শেষ মুহূর্তে মুরসিকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়।

মুরসিকে এমন মনে হতো, যিনি নিজের চেয়ে অনেক বড় মানুষের মধ্যে আটকে পড়েছেন। মিসরের একটি আদালতকক্ষের শব্দনিরোধক খাঁচার ভেতরে তিনি মারা গেলেন। প্রায় সাত বছর আগে মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের দিনটির কাছাকাছি সময়ে এ ঘটনা ঘটল। পরিবার ও মানবাধিকারকর্মী ছাড়া তাঁকে সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। বিচারে মুরসিকে ৪৫ বছরের বেশি কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ছয় বছর ধরে তিনি একা একটি নির্জন কারাকক্ষে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি মাত্র তিনবার তাঁর পরিবার-পরিজনের দেখা পেয়েছিলেন। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও লিভারের রোগে আক্রান্ত হলেও তাঁকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অথচ তাঁর আইনজীবীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছিলেন যে এসব রোগের যথাযথ চিকিৎসা না হলে মুরসির মৃত্যু হতে পারে।

যে আন্দোলন মুরসির নির্বাচনে দাঁড়ানোর পথটিকে সুগম করেছিল, সেই আন্দোলনের পর থেকে আমি প্রায় প্রতিদিন মিসরের অপর এক সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের মৃত্যুর খবরের খসড়া তৈরির কাজ করেছি। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, হোসনি মোবারক প্রথম মারা যেতে পারেন। কিন্তু ৬৭ বছর বয়সেই মুরসি মারা গেছেন। আর ৯১ বছর বয়সে মোবারক শুধু জীবিত নন, এখন মুক্ত মানুষও বটে। খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোহাম্মদ মুরসি বিজয়ী হয়েছিলেন। যখন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন অনেকগুলো শক্তি তাঁর বিরোধিতা করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, মোবারকের নিযুক্ত বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত মিসরের সর্বোচ্চ আদালত দেশটির সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে মুরসিকে দুর্বল করে দেওয়া।

মুরসির সমালোচকদের মতে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের চেয়ে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনের শক্তি সংহত করার চিন্তায় ব্যস্ত ছিলেন। আমার মতে, ২০১২ সালের নভেম্বরে মুরসির ব্যর্থতার সবচেয়ে মারাত্মক প্রকাশ ঘটে, যখন কোনো আদালত তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না, এমন বিধান রেখে তিনি ডিক্রি জারি করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দেশটির প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকেরা মুরসির বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। সংবিধানে একগুঁয়েভাবে ইসলামি শরিয়াহ আইন সংযুক্ত করাটাও ছিল তাঁর আরেকটি বড় ভুল। মুরসি আরেকটি ডিক্রি জারি করেন, যা সশস্ত্র বাহিনীকে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং ভোটের স্থানগুলোকে সুরক্ষিত রাখার কর্তৃত্ব দান করে, যতক্ষণ না মিসরীয়রা খসড়া সংবিধানে ভোট দেন। এ ঘটনায় আন্দোলনের সমর্থনকারীরা মুরসির তীব্র নিন্দা জানান। তাঁরা বলেন, মুরসি তাঁদের পক্ষে না থেকে সামরিক বাহিনীর পাশে থাকছেন।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার চার মাস পর মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের ১৪ জন সিনিয়র সদস্য বিচারের সম্মুখীন হন। প্রথমে মুরসিকে আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে অবস্থিত একটি উচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে এবং পরে কুখ্যাত তোরা কারাগারে রাখা হয়। তোরা কারাগারের একজন সাবেক কারারক্ষী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই কারাগারের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে কেউ একবার সেখানে গেলে মারা যাওয়া ছাড়া বের হতে পারে না। অন্যদিকে মোবারকের সঙ্গে করা আচরণটি দেখুন। তিনি মুরসির মতো এমন অমানবিক আচরণের শিকার হননি। কোনো কুখ্যাত কারাগারে তাঁকে রাখা হয়নি। একটি সামরিক হাসপাতালে তাঁকে আরামদায়কভাবে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে আদালতে আসতেন। তাঁর আইনজীবী বলেছিলেন, তাঁর মক্কেল খুবই মুমূর্ষু। যেকোনো সময় তাঁর মৃত্যু হতে পারে। মিসরের বর্তমান সামরিক শাসকেরা কখনো ভোলেননি যে মোবারক—সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান—একসময় তাঁদেরই একজন ছিলেন। ২০১৭ সালের মার্চে তাঁকে সামরিক হাসপাতাল থেকে নিজ বাড়িতে আনা হয়। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের ১১ দিনের মধ্যে প্রায় ৯০০ মানুষকে হত্যার জন্য কখনো মোবারককে দায়ী করা হয়নি।

মৃত্যুর পরও মুরসির সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার ধুয়ো তুলে মুরসিকে তাঁর নিজের প্রদেশ শরিকিয়ায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করার বদলে কায়রোর একটি কবরস্থানে দাফন করতে তাঁর পরিবারকে বাধ্য করা হয়েছে। ২০১৫ সালে মুরসিকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের আদেশ রদ করে সিসির সরকার। কারণ, তারা মুরসিকে শহীদের মর্যাদা দিতে চায়নি।

মিসরের রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোনো কোনো গণমাধ্যমে মুরসির মৃত্যুর খবরে এটাও বলা হয়নি যে তিনি একসময় দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মুরসির মৃত্যুদণ্ড রদ করা হয়েছিল। কিন্তু ছয় বছর ধরে নিষ্ঠুর আচরণ পাওয়ার পর আদালতকক্ষে যেভাবে তাঁর মৃত্যু হলো, সেটা মৃত্যুদণ্ড প্রদানের চেয়ে কম কী?

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
মোনা এলতাহাবি: মিসরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক