নিয়োগ ও পদোন্নতিতে বিশৃঙ্খলা

১৬ জুন প্রশাসনে ১৩৬ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের অধিকাংশই বিসিএস ১৭ ব্যাচের কর্মকর্তা। চাকরিতে যোগ দিয়েছেন ১৯৯৮ সালে। ২০ বছরের বেশি চাকরির অভিজ্ঞতা তাঁদের, পদোন্নতি তাই ন্যায্যভাবেই তাঁদের প্রাপ্য। তাঁদের চেয়ে জ্যেষ্ঠ কিছু কর্মকর্তা, যাঁরা এর আগে নানা কারণে পদোন্নতি পাননি, তাঁরাও এবার পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন।

সরকারের যুগ্ম সচিবের মোট পদসংখ্যা কমবেশি ৪৩০। সর্বশেষ এই পদোন্নতিপ্রাপ্তদের নিয়ে এখন তাঁদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ১ হাজারে। বিপুলসংখ্যক অতিরিক্ত কর্মকর্তা হয় ওএসডি হয়ে বসে থাকবেন, নয়তো নিম্ন পদেই কাজ করতে থাকবেন। আর প্রকৃত পদে নিয়োগের জন্য বিদ্যমান প্রতিযোগিতায় যুক্ত হবেন আরও কিছু। এ প্রতিযোগিতা শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে হবে না, এ কথা সবাই জানেন। অতিরিক্ত সচিব এবং সম্ভবত সচিব পর্যায়েও একই পরিস্থিতি বিরাজমান।

বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি শূন্য পদের বিপরীতেই হওয়ার কথা। বস্তুত, অন্য সব ক্যাডারেই এই নিয়ম খুব কড়াকড়িভাবে পালিত হয়, ব্যতিক্রম শুধু প্রশাসন ক্যাডার। এই ‘অনিয়ম’ শুরু হয়েছিল ১৯৭৯ ব্যাচের সব কর্মকর্তাকে একবারে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার মাধ্যমে, আর বহাল আছে আজ অবধি। ১৯৭৯ ও ১৯৮১ ব্যাচে নিয়োগ পরীক্ষায় কড়াকড়ির ফলে কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল খুব কম, ফলে সমস্যাটি প্রকট হয়ে ওঠেনি। ১৯৮২ থেকে শুরু করে বিপুলসংখ্যক নিয়োগের চাপে প্রশাসন ক্যাডারে সব নিয়মনীতি ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে উপেক্ষিত হয়েছে গুণগত মানের বিষয়টি।

স্বাধীনতার পর প্রথম বড় নিয়োগ হয়েছিল ১৯৭৩-এর মুক্তিযোদ্ধা ব্যাচ, যত দূর জানি, শুধু মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানই এ নিয়োগে মূল বিবেচ্য ছিল। পরিপূর্ণ ও মানসম্পন্ন পরীক্ষাপদ্ধতিতে নিয়মিত নিয়োগ শুরু হয় ১৯৭৯ ব্যাচ দিয়ে, ১৯৮১-তেও তা অব্যাহত থাকে। পরীক্ষার উচ্চ মানের কারণে খুব স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা এ দুই ব্যাচে উত্তীর্ণ হন। বিসিএসে উচ্চসংখ্যায় নিয়োগ শুরু হয় ১৯৮২ থেকে। তিন বছরের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হন ১ হাজার ৬০০-এর বেশি কর্মকর্তা। এর মধ্যে ৬৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয় শুধু মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে, যাঁরা পরে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হন। বেশি সংখ্যায় নিয়োগের এ ধারা অব্যাহত আছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাডারকে প্রশাসনে একীভূত করাও চলছে। প্রশাসন ক্যাডারে কর্মকর্তার বর্তমান সংখ্যা কমবেশি ৫ হাজার। পার্শ্ববর্তী বিশাল দেশ ভারতে আইএএস কর্মকর্তার সংখ্যাও মোটামুটি তা-ই।

বিপুলসংখ্যক নিয়োগে গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন, এটা আমরা সবাই জানি। নিম্ন পদের কর্মকর্তা তো বটেই, এমনকি কোনো কোনো সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার যোগ্যতা নিয়েও প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। ২০৪১-এ উন্নত বিশ্বের অংশ হতে চায় যে দেশ, এই বিলাসিতার সুযোগ নেই সে দেশের। কিছুদিন আগে একটা কথা কানে এসেছিল। খুব ক্ষমতাধর এক আমলা নাকি বলেছেন যে সব সচিব ভালো মানের হওয়ার প্রয়োজন নেই, অল্প কজন মেধাবী হলেই চলে। গাড়ির ইঞ্জিন যদি শক্তিশালী হয়, পেছনের বগি এমনিতেই চলবে। তাঁর এ তত্ত্বের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন। সচিবেরা সবাই ইঞ্জিন হওয়ার কথা, বগি নয়। বগি হবেন অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, যাঁদের সচিব নামক ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যাবে। এমনকি সেই বগিও যদি নিম্নমানের হয়, ইঞ্জিন ভালো হলেও গাড়ির গতি সীমিতই থাকবে।

বিপুল নিয়োগের আরেকটি সমস্যা হলো, ঊর্ধ্বতন নিয়োগে তদবিরবাজি। এক ব্যাচে যদি ২০০ কর্মকর্তা থাকেন, মেধায় প্রথম ১০ জন পদোন্নতি পেলে শেষ ১০ জন মনঃকষ্টে থাকেন তাঁদের ক্ষীণ সম্ভাবনার কথা ভেবে। প্রকৃতই মেধার ভিত্তিতে যদি পদোন্নতি হতো, তাহলে এটা খুব সমস্যা সৃষ্টি করত না। কিন্তু আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সেটা কল্পনা করাও কঠিন। চাকরিতে থিতু হওয়ার পরদিন থেকেই তাই তালিকার নিচের অনেকেই পরিকল্পনা শুরু করেন কীভাবে তাঁর ওপরের বিপুল সংখ্যাকে ডিঙিয়ে আগে পদোন্নতি হাসিল করা যায়। আত্মরক্ষার্থে তালিকার ওপরের অনেকেও এই যুদ্ধে শামিল হন। যুদ্ধ ও প্রেমের মতোই এ ক্ষেত্রেও কোনো সীমারেখা থাকে না গৃহীত পদক্ষেপের। ফলে আমলাতন্ত্রের নগ্ন রাজনৈতিকীকরণ। সঠিক যোগসূত্র না থাকলে, যিনি হয়তো মন্ত্রিপরিষদ সচিব হতে পারতেন, তিনি অতিরিক্ত সচিব হিসেবেও অবসরে যেতে পারেন।

মান ঠিক রাখতে এবং পদোন্নতির অরাজকতা দূর করতে তাই প্রশাসন ক্যাডারে সীমিত নিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, বিপুল জনগোষ্ঠীকে স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা দিয়ে কীভাবে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে। ভারতে আইএএস ছাড়াও বিপুলসংখ্যক প্রাদেশিক ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। আমাদের দেশেও সিএসপিদের পাশাপাশি সহায়ক হিসেবে যেমন ইপিসিএসরা ছিলেন। আমাদের প্রদেশ নেই, কিন্তু বিসিএস পরীক্ষায় যাঁরা অংশ নেন, অথচ যোগ্যতরদের নিচে থাকায় বিজ্ঞাপিত চাকরি পান না, তাঁদের ক্যাডারবহির্ভূত শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার বিধান চালু আছে। প্রশাসন ক্যাডারের বিদ্যমান পদসংখ্যার ২০ শতাংশ পদকে ক্যাডারে রেখে বাকি ৮০ শতাংশ পদকে মূল ক্যাডারগুলোর বাইরে একটি অধস্তন ক্যাডারে রূপান্তরিত করা সম্ভব। বিসিএস পরীক্ষায় যাঁরা পদ লাভ করবেন না, তাঁদের মধ্য থেকে এ পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া যায়। তাঁদের চাকরির শুরু হবে এক স্কেল নিচে এবং মাঠপর্যায়ের অধিকাংশ পদ তাঁরাই অলংকৃত করবেন, যেমন করতেন ইপিসিএসরা। ১০-১২ বছর চাকরির পর তাঁরা প্রথম শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এবং চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে কেউ কেউ উপসচিব/জেলা প্রশাসক হিসেবে স্বল্পসংখ্যক নির্দিষ্ট পদে পদোন্নতি পাবেন। এভাবে মেধাতালিকায় ঊর্ধ্বে থেকে যাঁরা ওই ২০ শতাংশ পদে নিযুক্ত হবেন, তাঁরা যথাসময়ে, সহজে এবং লবিং ছাড়াই পদোন্নতি পেতে পারবেন। মানসম্পন্ন কর্মকর্তা নির্বাচনও সহজ হবে। কাজটি শুরু করলে দৃশ্যমান ফল পেতে অনেক দিন লাগবে। তবু শুরু তো করতে হবে কোনো দিন।

পদোন্নতির সমস্যা মূলত প্রত্যাশার সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমদের সঙ্গে পড়তেন, লেখাপড়ায়ও ভালোই ছিলেন, এমন কেউ কেউ দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ঢুকে শেষ বয়সে প্রথম শ্রেণিতে পদোন্নতি পেয়ে খুশিমনে অবসর নিয়েছেন। তাঁরা জানতেন, ওটাই তাঁদের সীমা। সমান যোগ্যতার আরেকজন হয়তো অবসরে গেছেন অনেক ক্ষোভ নিয়ে, সচিব পর্যায়ে পদোন্নতিতে কেন তাঁকে বঞ্চিত করা হলো। যাঁরা চাকরিতে ঢুকবেন এটা জেনে যে তাঁর সর্বোচ্চ সীমা উপসচিব, যুগ্ম সচিব না হওয়ার বেদনা তাঁকে কাতর করবে না।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব