সৌন্দর্যের অধিকার বনাম হাইহিলের আধিপত্য

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি জাপানে কর্মক্ষেত্রে নারীর উঁচু হিলের জুতা পরার প্রচলনের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে উঠেছে আন্দোলন। আন্দোলনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘হ্যাশট্যাগ কু টু’। প্রায় ২০ হাজার নারী এক অনলাইন পিটিশনে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে, কোম্পানিগুলোয় নারী কর্মীদের উঁচু হিলের জুতা পরার বাধ্যবাধকতা বাতিল করা হোক। উঁচু হিলের জুতা শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এর ফলে পায়ের পাতায় ব্যথা হয়, মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া উঁচু হিলের জুতা দ্রুত হাঁটা কিংবা দৌড়ানোর পক্ষে অনুপযুক্ত। আন্দোলনটির নেত্রী ইউমি ইশিকাওয়া ও তাঁর অনুসারীরা যখন মনে করছেন, কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের নিয়ম লিঙ্গবৈষম্যকে উৎসাহিত করছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশে প্রচারিত হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সৌন্দর্য সাবানের বিজ্ঞাপন, যেখানে সৌন্দর্যচর্চার অনুষঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে হাইহিল জুতা, লিপিস্টিক ইত্যাদিকে। বিজ্ঞাপনগুলোর মডেল নিশ্চিতভাবেই অতি ছিপছিপে গড়নের এক তরুণী থাকে। বিজ্ঞাপনগুলোতে সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে শক্তিশালী করা হয়েছে সৌন্দর্য বাণিজ্যিকীকরণের সেই সনাতনী ধারণাকে।

শুনেছি, একসময় চীনে নারীদের ছোট পা’কে আভিজাত্য আর সৌন্দর্যের প্রতীক বলে মনে করা হতো। পা ছোট রাখার এই প্রয়াসে নারীরা সব সময় ছোট জুতা পরে থাকত, যেন পা বাড়তে না পারে। সে ছিল এক কষ্টকর প্রক্রিয়া। সমাজ নারীর গতিশীলতা পছন্দ করে না। পুরুষের চাই গতি আর নারীর চাই সৌন্দর্য। সময় পেরিয়ে গেছে, এসেছে অনেক উন্নয়ন আর পরিবর্তন। নারী আজ পৌঁছে গেছে মহাকাশে কিংবা এভারেস্টের চূড়ায়। কিন্তু নারীর সৌন্দর্যের আদর্শিক সংজ্ঞার কোনো পরিবর্তন আজও আসেনি। তাই তো বিজ্ঞাপনে সুন্দরী স্মার্ট নারীর গতিকে বারবার আটকে ফেলা হচ্ছে হাইহিল জুতার ফাঁদে। আরামদায়ক জুতা কিংবা কেডস পরিহিত গতিশীল নারীর আত্মবিশ্বাস ধরা পড়ে না প্রচলিত সৌন্দর্যের ধারণার মানদণ্ডে। শুনেছি, মেয়েরা নাকি প্রথম জুতা পরেছিল স্বামীর পাশে নিজেদের মানানসই উচ্চতায় রাখার প্রয়োজনে। ভেনিসের নারীরা একসময় অত্যন্ত উঁচু আর ওজনে ভারী হিলের একরকম জুতা পরিধান করত, যার নাম ছিল সপিন। সপিন ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সপিনকে আভিজাত্যের প্রতীক বলে মনে করা হতো। আভিজাত্যের আড়ালে সুকৌশলে নারীর অবাধ আর আরামদায়ক গতিশীলতাকে বেঁধে ফেলা হয়েছিল তখনই। সেই বাঁধন নারী আজও আলগা করতে পারেনি পুরোপুরিভাবে; কিংবা তাকে আলগা করতে দেওয়া হয়নি।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের এক সদস্য আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে নাকি একটি কোম্পানি সৌন্দর্য সাবানের বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি প্রথমে উৎসাহ প্রকাশ করলেও পরে বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট দেখে তিনি সরে আসেন। তিনি ভেবেছিলেন, তাঁকে হয়তো তাঁর নিজের ভূমিকাতেই বিজ্ঞাপনচিত্রটিতে অভিনয় করতে হবে; যেমনটি করে থাকেন বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটাররা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি যখন জানতে পারেন, তাঁকে বাথটাবে শুয়ে সাবান ব্যবহারের দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে, তখন তিনি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন এবং অবিলম্বে তাঁর অপারগতা প্রকাশ করেন। আমরা যদিও অনেকেই নারী ক্রিকেটারদের এগিয়ে যাওয়াকে সাধুবাদ জানাচ্ছি, কিন্তু স্বীকার করে নিতে পারছি না ক্রিকেটের পোশাকে সজ্জিত বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাংলাদেশি নারীর সৌন্দর্যের এই নতুন রূপটিকে। ক্রিকেটার নারীকেও তাই অনেকে কল্পনা করছেন বাথটাবের উষ্ণ জলে গোলাপের পাপড়ির আবরণে।

সৌন্দর্যের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা আছে বলে আমার জানা নেই। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। বিশ্বজুড়েই যেখানে ফরসা রংকে সৌন্দর্যের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার রাজনীতি প্রকটভাবে উপস্থিত, সেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সৌন্দর্যের বিপুলতা খুঁজে পেয়েছিলেন কৃষ্ণকলির কালো হরিণ চোখে। ‘কৃশকায়’ কিংবা ‘ফরসা রঙের নারী’কে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে ভূমিকা রেখেছে মূলত সিনেমা, বিজ্ঞাপন কিংবা ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো। তাদের এই প্রচেষ্টাকে লুফে নিয়েছে বিভিন্ন কোম্পানিগুলো। তারা খুব সুচতুরভাবে সাফল্যের সঙ্গে নির্বাচন করেছে তাদের গ্রাহকশ্রেণি এবং তাদের সামনে সৌন্দর্য নামক এমন এক মরীচিকার পথ দেখিয়েছে, যার অস্তিত্ব বাস্তব দুনিয়ায় নেই বললেই চলে। শুধু কি তা–ই! মেকআপ আর কম্পিউটারে ফটোশপে কাজ করে ইদানীং ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নারীর মেদবিহীন নিখুঁত সৌন্দর্য। অলীক এই সৌন্দর্যপ্রাপ্তির বাসনা কিন্তু বাস্তব হয়ে উঠছে অনেক নারীর কাছে। নারী তাঁর নিজের সৌন্দর্যকে অলীক এই সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করছেন। এই সৌন্দর্যে পুরুষও ভিরমি খাচ্ছে। সে তার কল্পনায় খুঁজে ফিরছে সেই অলীক সৌন্দর্য। কিন্তু কল্পনা আর বাস্তবতার দূরত্ব একসময় পরিণত হচ্ছে হতাশায়।

সৌন্দর্যের বাণিজ্যের ফাঁদে না পুরুষ খুশি, না নারী। মাঝখান থেকে বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো। সৌন্দর্যের এই ধারণাকে পুঁজি করে পৃথিবীজুড়ে চলছে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার বাণিজ্য। সৌন্দর্যহীনতার হীনম্মন্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমে নারীকে শেখাচ্ছে নিজের চেহারা কিংবা শরীরকে অপছন্দ করতে। ‘তুমি ততটা সুন্দর নও’ বলে তাদের আত্মবিশ্বাসকে প্রথমে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে তারপর তাদের প্রলুব্ধ করছে পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে পুনরায় আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে। কোনো কোনো পণ্য আবার নারীকে তার আসল সৌন্দর্য খুঁজে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কৌশলে তার সামনে এমন এক মানদণ্ডের সন্ধান দিচ্ছে, যা নারীকে আরও অস্থির করে তুলছে, তাকে হীনম্মন্যতায় ভোগাচ্ছে। এ যেন এক মজার খেলা!

নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য মূলত তার আত্মবিশ্বাসে। আত্মবিশ্বাস থেকেই প্রকৃতপক্ষে জন্ম নেয় সৌন্দর্য। এটি শুধু নারী নয়, পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নারীর জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো নিজের মতো করে পথচলা আর স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার, যা বিকাশ ঘটাতে পারে তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের। আত্মবিশ্বাসী, সাহসী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীই কেবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে সৌন্দর্যের ঘুণে ধরা প্রচলিত সংজ্ঞা। নারীই নির্ধারণ করুক, সে কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবে। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন নিজেকে জানা, আত্মবিশ্বাসী হওয়া এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হওয়া। সৌন্দর্য নয়, বরং ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী নিজেকে উপস্থাপন করতে পারাই নারীর অধিকার। রং ফরসাকারী ক্রিম, হাইহিল জুতো, কিংবা কড়া লিপিস্টিকের ভারে চাপিয়ে দেওয়া অস্তিত্ব যেন কেড়ে না নেয় নারী প্রকৃত সৌন্দর্য, গতিশীলতা আর আত্মবিশ্বাস। নারীর সৌন্দর্য তার স্বকীয়তায়, নারীর সৌন্দর্য তার অনুভবের স্বাধীনতায়, নারীর সৌন্দর্য তার মুক্তিতে। এখন সময় এসেছে নারীর সৌন্দর্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার। 

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]