বাংলার ট্র্যাজিক মুখ নবাব সিরাজ

আজ ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ দিবস। বাঙালি মাত্রেরই দিবসটির মনে রাখা দরকার ছিল। কিন্তু বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব নাটক-সিনেমায় যতটা অশ্রু আকর্ষণ করেন, বাস্তবে ততটাই উপেক্ষিত তাঁর মর্মান্তিক পরিণতি। তাঁর পরিণতি আর বাংলা অঞ্চলের কোটি মানুষের পরিণতি একাকার হয়ে গিয়েছিল। পলাশীর পরাজয়ে ভারতবর্ষে ইংরেজদের বর্বরোচিত ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরাজয়ইবা বলি কী করে, সেদিন তো কোনো যুদ্ধই হয়নি। যা হয়েছে, তা ছিল ইংরেজ কোম্পানির শঠতা আর দেশীয় অভিজাততন্ত্রের বিশ্বাসঘাতকতা। সিরাজের জন্ম বাংলায়, তিনি যে শাসন-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করেন, সেটাই বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে ইতিহাসে প্রথম মর্যাদা দেয়। সেন আমলের কুলীন প্রথা, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও নির্দয় সামন্তবাদে মানুষ অতিষ্ঠ ছিল। বৌদ্ধরা হয়েছিল হত্যা-নির্যাতন ও দেশান্তরের শিকার। এরই সুযোগ নেয় তুর্কি ভাগ্যসন্ধানী আগ্রাসী সেনাপতি বখতিয়ার খলজি। যদিও সেনেরাও বাঙালি ছিল না, তারা ছিল কানাড়ি। এহেন সেন আমলে দরবারি ধর্ম ও সাহিত্যচর্চায় বাংলা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। রামায়ণ–মহাভারতের বাংলায় অনুবাদ ও স্বীকৃতি, চৈতন্যদেবের উদ্ভবের পরিবেশ সৃষ্টি ছাড়াও মঙ্গলকাব্যের বিকাশ, বাংলায় দলিলপত্র লেখার সূচনা, গ্রামগঞ্জে বাংলায় পুঁথি-পাঁচালির বিস্তার সুলতানি আমলেরই ঘটনা।

সুলতানি আমলে হিন্দু-মুসলিমের মিশ্র শাসন কায়েম হয়। সুলতান বেশির ভাগ সময়ই হন একজন মুসলমান, কিন্তু অভিজাতেরা, আমলারা, জমিদারেরা বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু। বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম একজন স্বাধীন সুলতান নিজেকে ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সুলতানি আমলে যে বাংলা, বাঙালি ও স্বাধীনতার ধারণা জোরদার হয়, তারই ধারাবাহিকতায় আসে আলিবর্দী খাঁ ও সিরাজউদ্দৌলার ট্র্যাজিক জুটি। সুতরাং যাঁরা বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার চেতনাকে গুরুত্ব দেন, তাঁদের কাছে বাংলার স্বাধীন সুলতান ও নবাবেরা বাঙালিত্বের বনিয়াদ নির্মাতা হিসেবেই স্বীকৃত হবেন।

সিরাজের শত্রু তাই বাংলার শত্রু। তখনো এখনো। সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই বছর পর সিপাহি বিদ্রোহ হলো বিদেশি আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে। তিনটি ক্ষেত্রেই জাতীয় শত্রু ছিল ইংরেজ-জমিদার-মহাজন-বাবু এবং তাঁদের শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা। সাঁওতালদের লড়াই, সিরাজের লড়াই, সিপাহিদের লড়াই এখানেই এক সুতোয় গাঁথা।

ইংরেজ-বেনিয়া-জমিদারশ্রেণি মিলে বাংলাকে বিকিয়ে দিল, কৃষক-ভূস্বামীদের এমনভাবে নিঃস্ব করল যে পলাশীর ১২ বছরের মাথায় ছিয়াত্তরের (১৭৭০ সাল) দুর্ভিক্ষে এক কোটি বাঙালি মারা গেল। সেচব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় কৃষি চিরতরে দুর্বল হলো। সে আমলের শিক্ষিত-সংস্কৃতিমান লোকেরা বর্জিত হলো। মুসলমান অভিজাত, পণ্ডিত থেকে কৃষক সবাই নিঃস্ব হলো।

স্বাধীন বাংলার পরাধীনতার প্রক্রিয়ার শুরু ১২ বার মারাঠা আক্রমণ ও লুটতরাজের মধ্য দিয়ে। ১৭৪২ থেকে ১৭৫২ সাল পর্যন্ত বারবার মারাঠা আক্রমণে কৃষকের ক্ষতি হয়, রাজস্ব নষ্ট হয়, বহু লোক নিহত এবং বহু নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার ও অপহৃত হয়। এই বিপর্যয় দমনে নবাব আলিবর্দী খাঁর সেনাখরচ বাড়ে, অর্থনীতি কমজোরি হয়। মুশকিল হলো মারাঠাদের আক্রমণ ছিল দস্যুর মতো গেরিলা কায়দায়। তারা যুদ্ধে কোনোভাবেই বাংলা বাহিনীর মুখোমুখি না হওয়ায় তাদের ঠেকানো যাচ্ছিল না। তখন ছলনা করে মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিতসহ ২২ জন সেনাপতিকে সন্ধির নামে নজরানার লোভ দেখিয়ে আমন্ত্রণ করে এনে হত্যা করেন আলিবর্দী।

মারাঠা দমন হলেও কিন্তু সেই যে অর্থনৈতিক দুর্বলতা শুরু হলো, তা মেটাতে সিরাজউদ্দৌলা রাজবল্লভ-উমিচাঁদের মতো সুদি মহাজনদের কাছে ঋণ করতে বাধ্য হন। ব্যাংক পুঁজির মালিক জগৎ শেঠ পরিবার রাষ্ট্রকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে। চিরকালই বণিকেরা ক্ষমতাবান হলে সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিতে পড়ে।

এ রকম অবস্থায়ও সিরাজ দিল্লির সম্রাটের বন্ধু ইংরেজের ইয়ার পুর্ণিয়ার নবাবের বাংলা আক্রমণ ঠেকান এবং তাঁকে হত্যা করেন। কিন্তু ঘসেটি বেগমের মতো আত্মীয় এবং মানিকচন্দ্র ও মীরজাফরের মতো সেনাপতিদের বেইমানি তিনি প্রতিরোধ করতে পারেননি। ইংরেজ ও দিল্লি উভয় শক্তিই তাঁকে সরাতে চাইছিল তাঁর স্বাধীনচেতা রাষ্ট্রনীতি এবং বিপ্লবী ফরাসিদের মিত্র হওয়ার জন্য। একই কারণে মহীশুর-হায়দরাবাদের নবাব টিপু সুলতানও ইংরেজদের চক্ষুশূল ছিলেন।

১৭৫৭ সাল। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না। নবাব বুঝতে পারলেন, তাঁকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্রে সেনাপতিরাও শামিল। পলাশীর যুদ্ধ নামক জরুরি অবস্থার শিকার হয়ে নবাব ও তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমর্দান ও মোহনলাল জীবন হারান। দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহী মূল চরিত্রদের নাম দেখলে বোঝা যায়, এটা মোটেই মুসলমানি শাসন রক্ষার যুদ্ধ ছিল না। বিশ্বাসঘাতকের মধ্যেও যেমন হিন্দু-মুসলিম ছিল, তেমনি আত্মত্যাগী শহীদদের মধ্যেও ছিলেন উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ। মধ্যযুগে শাসনকে সাম্প্রদায়িকভাবে নয়, বংশ দিয়ে চেনা হতো।

যা হোক, পরাজিত নবাবকে বন্দী করে আনা হয় তাঁরই রাজধানীতে। স্বাধীন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের কিছু এলিট তাঁকে উপহাস করে। তাঁর উচিত শাস্তি হয়েছে বলেও বলা হয়। তাঁরই রাজধানীতে তাঁর লাশকে অপমান করা হয়। মুর্শিদাবাদের এলিট ও সুশীল সমাজ সেদিন বুঝতে ব্যর্থ হয় যে সিরাজকে হিংসা করতে গিয়ে তারাই আসলে ক্ষমতা হারাল। তার পরের পৌনে ২০০ বছর ইংরেজ ও তাদের দালাল বুদ্ধিজীবীরা তাঁর চরিত্রে কালিমা ছিটায়। কলকাতার সেরা বুদ্ধিজীবীরা সিরাজকে ভিলেন বানিয়ে ইংরেজকে পরিত্রাতা হিসেবে বন্দনা করেন। সিরাজের রাজকোষের টাকা চুরি করে ইংরেজের দুর্গে আশ্রয় নেওয়া নবকৃষ্ণ দেব সিরাজের পতনের পরে কলকাতার বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে ইংরেজের উন্নয়নের সুফল জমিদাররা পেয়েছিলেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হয়েছিল বাংলা।

অন্ধকার যুগের শুরুতে কোনো বিউগল বাজে না। যদি বাজে, বুঝতে হবে সেটা কাশিমবাজার কুঠির ষড়যন্ত্রের বাঁশি।

সব দেশেরই একটা ট্র্যাজিক মুখ থাকে, সিরাজ হলেন বাংলার সেই ট্র্যাজিক বীর। সিরাজের অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনিই ছিলেন স্বাধীন বাংলা সাম্রাজ্যের শেষ রক্ষক। এই সত্যটা বুঝতে বাঙালির ২০০ বছর লেগেছিল। যুগে যুগে জাতির ট্র্যাজিক মুখের উদয় হয় এবং জনতার আদালতে তাঁদের বিজয়ও হয়।

কলকাতার রেনেসাঁ বলে যা বলা হয়, তার সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আনুগত্যের পরিবেশে। সিরাজকে ঘৃণা করার সংস্কৃতি একধরনের সাম্প্রদায়িকতা এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতার ফল। সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবোধ বাঙালির নায়ককে বানায় খল আর খলকে বানায় নায়ক। তাই ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে হলে ইতিহাসচর্চাকে আগে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে হবে। ইতিহাস নাকি শিক্ষা দেয়। কিন্তু ভুল শেখানোর ইতিহাসচর্চাকে যদি আগে শিক্ষিত না করি, তাহলে ইতিহাসের নামেই চলতে থাকবে সাম্প্রদায়িক হিংসার উৎসব। বিশ্বে ও ভারতবর্ষে হিংসার পরিবেশে বাংলা ও বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চাকে বিদ্বেষের হাতিয়ার হওয়া থেকে বাঁচানো তাই জরুরি কাজ।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]