কালোটাকা আর সঞ্চয়পত্র একই কাতারে

সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ করছেন নানা ধরনের মন্তব্য। নির্মোহভাবে বলতে হবে, বাজেটের প্রশংসা করার মতোও বেশ কিছু দিক আছে। যেমন বৈদেশিক সহায়তা-নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আরও প্রসার, উচ্চতর প্রবৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের সুবিধা, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের ওপর কিছুটা প্রণোদনা ইত্যাদি। অন্যদিকে কালোটাকা কতিপয় ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য শতকরা ১০ ভাগ আয়কর দিলেই নিয়মিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হারে হাত না দিলেও আয়কর উন্নীত করা হয়েছে ১০ শতাংশ হারে। কোটি কোটি লোকের নিত্যব্যবহার্য মুঠোফোন ও ডেটা ব্যবহারের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর ২৭ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। মোটাদাগে দেশের ধনিকশ্রেণির দিকেই বাজেটটি ঝুঁকে পড়েছে বলে সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির নজর গত দুই দশকে বড় ধরনের মোড় নিয়েছে। সংগঠনটি সৃষ্টির সূচনা থেকেই নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের চাহিদাকে সর্বাগ্রে স্থান দিত। এখন বিপরীতমুখী হয়েছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধনিকশ্রেণির নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে জোরদার হচ্ছে।

অন্যদিকে ব্যাংক খাতে আমানতের হার ক্রমহ্রাসমান। অবস্থাটিকে সংকটজনক বলে অনেকেই মনে করছেন। কদিন আগে দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল—‘ব্যাংক থেকে এত টাকা গেল কোথায়’। খবরটিতে রয়েছে একই বাজারে বিভিন্ন ব্যাংক ৭ থেকে ১৪ শতাংশ মুনাফায় আমানত নিচ্ছে। পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছেন না ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। ঋণের সুদের হারও ক্ষেত্রবিশেষে ১৬-১৭ শতাংশ বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ রয়েছে, বর্তমান বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আরও ১৭ হাজার কোটি টাকা। অবলোপনসহ হিসাব করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। তাই এত টাকা কোথায় যায়, সে প্রশ্নের জবাব খুব কঠিন, এমন তো মনে হয় না। একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেছেন, আমানতের ২৬-২৭ শতাংশ সঞ্চয়পত্রে চলে গেছে। হতে পারে। এর জন্য সরকারকে কিছু বেশি সুদে ধার করতে হবে। তবে টাকাগুলো তো কোথাও মার খায়নি। অবশিষ্ট আমানত তো ব্যাংক আর শেয়ারবাজারে। সেখানকার হাল সবারই জানা। খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংক ভারাক্রান্ত। এর জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চিতিও নেই সব ব্যাংকে। ফলে গোটা ব্যাংক ব্যবস্থাই একরকম হুমকির মুখে।

বলা হয়, কালোটাকা সাদা না করলে বিদেশে পাচার হবে। এটা শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা। অবশ্য স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় সব সরকারই কোনো না কোনোভাবে এ ব্যবস্থা রেখেছে। তবে ঢালাও শতকরা ১০ ভাগ আয়কর দিয়ে দুটো খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নিয়মিত আয়করদাতাদের প্রতি অবিচারের নামান্তর। আর এভাবে সুযোগ দিয়ে খুব বেশি টাকা বিনিয়োগে এসেছে, এমন কখনো দেখা যায়নি। তাহলে এ অনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার দায়বদ্ধতা কোথায় এবং কেন? এসব টাকা ব্যাংকের তারল্যসংকট দূর করতে তেমন একটা কাজে আসবে না। তবে শিল্প-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শক্তিশালী একটি মহল এর পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে নির্মাণ খাত এ দাবিতে ছিল সোচ্চার। তাদের সুবিধার্থে প্লট ও ফ্ল্যাট কেনার রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা হয়েছে। প্রয়োজন বিবেচনা করলে দেওয়া যেত আরও ছাড়। এতে এগুলোর ক্রেতা মধ্যবিত্ত শ্রেণিও উপকৃত হবে। অবশ্য এ খাতে কালোটাকা সাদা করতে নিয়মিত হারে আয়করের বিধান রয়েছে। ঢালাও ছাড় দেওয়া হয়েছে দুটো খাতে। সেসব কালোটাকার একই কাতারে আয়কর ধরা হয়েছে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর। বেশ কিছুকাল ধরেই একটি মহল সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন ‘কুফল’-এর ওপর বিভিন্ন রকম তথ্য তুলে ধরছে। সরকারি ব্যয় সীমিত রাখতে তার সুদ খাতে ব্যয়ের রাশ টানার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের সুবিধাভোগীদের বিরাট অংশ এর মাধ্যমে একটি সামাজিক নিরাপত্তাবলয় ভোগ করছে, এটাও দেখার বিষয়। অন্যদিকে ঘাটতি ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে অধিক ধার নিলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা আরও বিপাকে পড়বেন। তাই সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাটিকে আর বিপন্ন করা যৌক্তিক হবে না।

ব্যাংক খাতে তারল্যসংকটের জন্য খেলাপি ঋণের ভূমিকাই মুখ্য, এটাই ব্যাপকভাবে বিবেচনা করা হয়। এসব ঋণ নিয়মিত করতে বিভিন্ন ধরনের কৌশল নিকট অতীতেও ফলপ্রসূ হয়নি। আমানত সঞ্চয়পত্রমুখী হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ব্যাংকের অত্যন্ত অনাকর্ষণীয় মুনাফার হার। আগে এমনটা ছিল না। অনেকেই স্থায়ী আমানতেও ব্যাংকে টাকা রাখতেন। ব্যাংক যখন এর প্রকৃত মুনাফা মুদ্রাস্ফীতির বেশ নিচেই নামিয়ে নিল, তখন আমানতকারীদের এ প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক বলা যাবে না। সরকার সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাটি সংস্কারে হাত দিয়েছে। নীতিগতভাবে একে স্বাগত জানাতে হয়। তবে সঞ্চয়পত্রের পরিমাণ এক লাখ টাকার ওপরে হলেই কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) লাগবে, বিষয়টি পুনরায় বিবেচনাযোগ্য। হিসাব করলে কারও কারও আয়করই আসে না। তবু উৎস কেটে নেওয়া হচ্ছে। এখন এগুলো নবায়ন করতে হলে তাদেরও টিআইএন খুলতে হবে। এ বিষয়গুলো ভেবে দেখা প্রয়োজন। যাঁরা এসব বিধান করছেন, তাঁরা বহাল আছেন চাকরিতে। বেশ ভালো টাকা বেতন-ভাতা পান। তাঁদের বেতনের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিডেন্ট ফান্ডে রাখতে পারেন। এর সুদহার ১৩ শতাংশ। কোনো আয়করও নেই।

ব্যাংক খাতে বাস্তবমুখী নীতি গ্রহণ করলে তারল্যসংকট হয় না। মুনাফা করে ব্যাংক। গ্রাহককে ঋণ দিতে পারে। কমিয়ে আনা যায় খেলাপি ঋণ। এ দৃষ্টান্ত কিন্তু কয়েকটি ব্যাংক এর মধ্যেই সামনে নিয়ে এসেছে। বেসরকারি খাতের শীর্ষে অবস্থান করা একটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার ছেপেছে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিক। তাঁর ভাষ্যমতে, সেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বর্তমানে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অথচ এ খাতে গড় খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশের ওপরে। অবিশ্বাস্য হলেও সেই ব্যাংকের দাবি তথ্য দ্বারা সমর্থিত। ২০১৮ সালে তাদের মুনাফার পরিমাণ ৩০৮ কোটি টাকা। শেয়ারমালিকেরা মুনাফা পেয়েছেন ৩০ শতাংশ হারে। ব্যাংকটি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের শতকরা ৪ ভাগ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। বিদেশে শাখা খোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। অথচ সে ব্যাংক আমানত নেয় ৮ দশমিক ৫ থেকে ৯ শতাংশ সুদে। ব্যাংকটি দেশের বড় কয়েকটি প্রকল্পসহ অনেক ক্ষেত্রেই অর্থায়ন করে যাচ্ছে। তারল্যসংকট আর সঞ্চয়পত্রের ওপর আর অভিযোগ নেই।

উল্লেখ করা হয়েছে, সঞ্চয়পত্রের একটি সামাজিক দিক আছে। তাই বিভিন্ন প্ররোচনার পরও সরকার এর মুনাফার হারে গত বছর তিনেক হাত দেয়নি। এগুলোতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধনিকশ্রেণির কিছু লোক বড় অঙ্কের টাকা বেনামে বিনিয়োগ করতে পারেন। বিশেষ করে, পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে এটা সম্ভব। তাঁদের শনাক্ত করে মুনাফা কিংবা আসল বাজেয়াপ্ত করা যায়। তবে পেনশন সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র কিংবা পরিবার সঞ্চয়পত্রের এসব লোক বিনিয়োগে আছেন বলে মনে হয় না। পেনশন সঞ্চয়পত্রে তো সুযোগই নেই। এসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর আয়ের প্রধান উৎস এগুলোই। প্রবৃদ্ধির হারের পাশাপাশি বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। সঞ্চয়পত্রের সুবিধাভোগী লোক কিন্তু অনেক। এ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের ভিতে ধস নামলে সামাজিক অস্থিতিশীলতা আসবে। এমনিতেই বাজেটের কল্যাণে আমাদের বেশ কিছু ব্যয় বাড়বে। আর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা থেকে বর্ধিত হারে আয়কর কেটে নিলে সেটা হবে বোঝার ওপর শাকের আঁটি। ধনিকশ্রেণির জন্য বাজেটে অনেক সুবিধা রয়েছে। তাদের প্রণোদনা সব ক্ষেত্রেই অসংগত, এমনও নয়। ঠিক তেমনি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিও রাষ্ট্রের নজর দাবি করে। এর একটি বড় হাতিয়ার সঞ্চয়পত্র।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]