শিক্ষক আমদানির বুদ্ধিটা কার?

চক্ষু চড়কগাছ! প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনা হবে। বাজেটের এই প্রস্তাব আমাদের শিক্ষার দৈন্য দশাকেই প্রকাশ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত যদি বিদেশি শিক্ষক নিয়েই আসা হয়, তবে এত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বরাদ্দ বৃদ্ধি করে কী লাভ? আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িয়েছি, শিক্ষক–শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করতে পারিনি।

কোন পর্যায়ে শিক্ষক আনা হবে, তা নিশ্চিত না। তবে আলোচনার সুবিধার জন্য ধরে নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগগুলোয় বিদেশ থেকে দক্ষ শিক্ষক আনা হবে। এ ক্ষেত্রে জাপানের সম্রাট মেইজির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। জাপানের পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মিলিয়ে ফেলা সমীচীন না। আমাদের বিশাল মানবসম্পদ রয়েছে। এই জনসম্পদের চার কোটি এখন বেকার; বাংলাদেশ পরিসংখ্যার ব্যুরোর হিসাবমতে। এদের আমরা উপযুক্ত ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। কারণ, গণহারে বিশ্ববিদ্যালয়–কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। নিম্নমানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরাজনীতির কারণে অপ্রয়োজনীয় বিভাগ চালু করা হয়েছে। কিন্তু মান ও গবেষণার দিকে নজর দেওয়া হয়নি।

সব সরকারই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে গুরুত্ব দিয়েছে বলে দাবি করে। কিন্তু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১৫ দশমিক ২ শতাংশ অর্থ, যা দেশজ মোট উৎপাদনের ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বাজেটের ২০ শতাংশ অর্থ বা দেশজ উৎপাদনের ৬ শতাংশ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় করাই আদর্শ। শুধু বরাদ্দ বৃদ্ধি করলেই হবে না; এর সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী নীতিরও বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ছে বটে, কিন্তু শিক্ষাবিষয়ক নীতিগুলো কার্যকর ও শ্রমবাজারভিত্তিক মনে হচ্ছে না। উচ্চশিক্ষার কথাই ধরুন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ খোলার হিড়িক পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন সব বিভাগ খোলা হয়েছে, যেগুলো একটি–দুটি কোর্স বা বড়জোর মাস্টার্স প্রোগ্রাম হিসেবে পড়ালেই যথেষ্ট। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন এবং টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি নামে তিনটি বিভাগ খোলা হয়েছে। এতে করে নিজস্ব লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরাজনীতির সুবিধা হয়েছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন নতুন বিভাগ চালু হয়েছে, ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হয়নি।

উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করতে না পারার অন্যতম কারণ গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ না দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে মাত্র ৫০ কোটি টাকা বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। উন্নত উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রধান অংশই হচ্ছে গবেষণা। কেবল শ্রেণিকক্ষে পাঠদানেই উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি হয় না; শ্রেণিকক্ষে অর্জিত তাত্ত্বিক জ্ঞানকে পরীক্ষার সুযোগ করে দেয় গবেষণা। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষক–শিক্ষক তৈরির কারখানা। এক অধ্যাপকের কতগুলো গবেষণা প্রকল্প চলছে, তার ওপর নির্ভর করে অধ্যাপকের মান। উন্নত বিশ্বে অধ্যাপকের সংখ্যা ও গবেষণাকেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় সমান। এখানে বলে রাখা ভালো, অধ্যাপকেরা উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধীনেই গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেন। আর আমদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেকার ও রাজনৈতিক ক্যাডার তৈরি কারখানা। ইউরোপের দুটি দেশে আমার শিক্ষা লাভের সুযোগ হয়েছে। সুইডেন ও জার্মানিতে দেখেছি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাভিত্তিক। আর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলো শ্রমশক্তি তৈরির জন্য কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতেও গবেষণা হয়। তবে এরা গবেষক তৈরি থেকে জনশক্তি তৈরিতে বেশি মনোযোগী। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা বাদ দিয়ে জনশক্তি তৈরিতেই মনোযোগী। সন্দেহ নেই আমরা ভালো ভালো আমলা বা করপোরেট হাউসগুলোর জন্য জনশক্তি তৈরি করতে সফল হচ্ছি। কিন্তু গবেষক তৈরি করতে পারিনি। তাই উপযুক্ত শিক্ষকের সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণেই সরকার বিদেশ থেকে শিক্ষক আনার কথা চিন্তাভাবনা করছে।

বিদেশ থেকে শিক্ষক এনে সুবিধা হবে না যদি গবেষণার পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সুবিধা না থাকে। কারণ, বিদেশি শিক্ষকেরাও এসে গবেষণার সুযোগ-সুবিধার খোঁজ করবেন। অন্যথায় মানসম্পন্ন শিক্ষকেরা আসতে চাইবে না। কেবল মেধাবী শিক্ষক দিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতের শিক্ষক তৈরি করা যাবে না। যদি তা–ই হতো, তবে আমাদের আর বিদেশে শিক্ষকের জন্য খোঁজ করতে হতো না। দেশে মেধাবী শিক্ষার্থীর অভাব নেই। কিন্তু গবেষকের অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব ও শিক্ষকরাজনীতির জন্য অনেকেই গবেষণায় উৎসাহিত হচ্ছেন না।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথমেই গবেষণায় বরাদ্দ কয়েক গুণ বাড়াতে হবে। হুটহাট করে নতুন নতুন বিভাগ শুরু না করে ওই অর্থ বিদ্যমান বিভাগগুলোয় গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেওয়া উচিত। বরং বিভিন্ন বিভাগের অধীনে একাধিক মাস্টার্স প্রোগ্রাম শুরু করা যেতে পারে। যেমন ঢাবির ওই তিনটি বিভাগ বন্ধ করে দিয়ে ওই অর্থ গবেষণার জন্য গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের দেওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভিসি ও ডিন হওয়ার জন্য শিক্ষকেরা রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেন। ভিসি ও ডিন হওয়ার জন্য কিছু নিয়মকানুন যুক্ত করা উচিত। যেমন ভিসি হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৫০টি পিএইচডি ও এমফিল গবেষণা তত্ত্বাবধানের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ডিন হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩০টি। গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব লাভের জন্য শিক্ষকদের নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করতে হবে। বিদেশি পিয়ার রিভিউ জার্নালে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে হবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষকদের গবেষণায় আকৃষ্ট করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ন্যূনতম যোগ্যতা হবে পিএইচডি। তবেই মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি হবে।

বিদেশি শিক্ষক না এনে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে শিক্ষাবিনিময় প্রকল্প শুরু করা উচিত। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে শুরু করা যেতে পারে। আমাদের শিক্ষকেরা এক সেমিস্টার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে আসবেন। ওদের শিক্ষকেরা এসে আমাদের এখানে পাঠ দান করবেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা যাবে ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওদের শিক্ষার্থীরা আসবেন।

এসবের পাশাপাশি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। দলীয় ক্যাডারদেরই নিয়োগ দিন। কিন্তু তাঁদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত মেধাবী ও গবেষণায় অভিজ্ঞদের নিয়োগ দিতে হবে। কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা বলি। বিভাগে সর্বোচ্চ রেকর্ড নম্বর পাওয়ার পরও একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেননি। কারণ, নিয়োগ পরীক্ষার দিন কয়েকজন প্রার্থীসহ ভিসিকে আটকে রাখা হয়। উদ্দেশ্য, দলীয় ক্যাডারকে নিয়োগ দেওয়া। হয়েছেও তা–ই। যখন যোগ্য প্রার্থীদের আটকে রাখা হয়, অপহরণ করা হয়, গবেষণায় বরাদ্দ থাকে না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটের ৭০-৭৫ ভাগ শিক্ষক–কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য খরচ করা হয়, তখন দেশে উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব থাকবেই। এটাই স্বাভাবিক। বিদেশি শিক্ষক দিয়েও সেই অভাব পূরণ করা যাবে না। পরিস্থিতিরও কোনো পরিবর্তন আসবে না। এই ব্যর্থতার দায় যাঁদের, তাঁদের জায়গায়ও কি বিদেশি পরিচালক, নেতা, প্রশাসক আমদানি করে বসানো যায় না?

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।