ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন: বাধা কোথায়?

বিশ্বব্যাংকের সর্বসাম্প্রতিক ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদনে তিন বছরে ভারতের অবস্থান ১৩১ থেকে ৭৭–এ এসে দাঁড়িয়েছে, আর বাংলাদেশ দুই ধাপ পিছিয়ে ১৭৪ থেকে ১৭৬–এ নেমেছে। এটি নিয়ে ‘বাংলাদেশের বন্ধুদের’ মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তারা বলছে—কী সমস্যা? বাংলাদেশের অবনমন হচ্ছে কেন? ব্যবসা শুরু, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, ইনসলভেন্সি ফ্রেমওয়ার্কসহ অন্য অনেক বিষয় আমরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে আসছি। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ সহায়তায় অনেক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের আমি বলেছি যে এখানে সমস্যা কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা কিংবা অতিনিয়ন্ত্রণ নয়; বরং সমস্যা হলো নিয়ন্ত্রণমূলক অনিশ্চয়তা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক শাসনের অধীনে আইন বা বিধির সুবিধাজনক ব্যাখ্যা হাজির করা।

দেশের জাতীয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সামনে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণমূলক অনিশ্চয়তাই প্রধান প্রতিবন্ধক। এই প্রতিবন্ধকের বিরূপ প্রভাবের মধ্যে রয়েছে অদক্ষতাজনিত উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও উত্পাদনব্যয় বৃদ্ধি। চূড়ান্তভাবে এটি প্রধান প্রধান বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে একটি অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে দেশি–বিদেশি ব্যক্তি খাতের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হন। এই দীর্ঘমেয়াদি অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে উত্তরণের যেকোনো প্রচেষ্টায় গভীর রোগনির্ণয় বা সমাধান গুরুত্বপূর্ণ। প্রারম্ভিক পরিকল্পনার ধাপ থেকে প্রয়োগের যেকোনো সময়ে এই নিয়ন্ত্রণমূলক দ্ব্যর্থবোধকতা ছড়াতে পারে।

প্রায়ই ক্ষেত্রসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে প্রাক্‌–আলোচনা বা মূল্যায়ন ছাড়া নতুন নীতি ও বিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হয়। ব্যক্তি খাতের প্রতিযোগীদের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। এই অন্তর্ভুক্তিহীনতার কারণে প্রাথমিক বিধিমূলক খসড়াগুলো ব্যবহারিক অন্তর্দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়, সেটা শুধু ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তারাই ধারণ করেন। ফলে একটি দুর্বল ও অস্থিতিশীল জ্ঞান বুনিয়াদের ভিত্তিতে একটি অদক্ষ নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো তৈরি হয়। তবে ধারণাগতভাবে এসব নতুন বিধি শক্তপোক্ত হলেও সেগুলো প্রকাশ বা বাস্তবায়নের তাৎক্ষণিক ঘোষণা চলমান ব্যবসায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আইএফসি ও বিল্ডের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারী মোট ৮৩ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই একমত যে প্রাক্‌–আলোচনা বা পরামর্শ ছাড়াই নীতি ও বিধি প্রণয়ন কিংবা কার্যকর করায় তা তাদের ব্যবসায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অধিকন্তু ওই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৭ শতাংশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে তাদের পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি হবে না এবং না করা হলে কেন নয়, সেই সম্পর্কে সরকার কমই জানায়। দুর্ভাগ্যক্রমে এই যোগাযোগ ব্যবধান শুধু সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নয়, বিভিন্ন আন্তসরকারি এজেন্সিও নিজেদের নিয়ন্ত্রণমূলক সিদ্ধান্তে কার্যকরভাবে সমন্বয় সাধনে ব্যর্থতা দেখিয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনায় বড় ধরনের অসামঞ্জস্য ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। ফলে ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি ও ভুল হয়। এভাবে নিয়ন্ত্রণজনিত অনিশ্চয়তা ও সমন্বয়হীনতা ব্যক্তি খাতের সার্বিক বিনিয়োগ প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণমূলক অনিশ্চয়তার আরেকটি প্রধান কারণ দলিলপত্রের নির্ভরযোগ্যতার অভাব। এই সমস্যার দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস বা দিক রয়েছে। প্রথমত, বিপুলসংখ্যক এসআরও এবং অন্যান্য আইনি বিধান হালনাগাদ কিংবা প্রয়োজনের নিরিখে পর্যালোচনা, পরিবর্তন কিংবা বাতিল করা হয় না। ১৯৪৭ সালের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ৭০০–এর বেশি বন্ড–সংক্রান্ত এসআরও কেবল ভাসা–ভাসা অবস্থায় রয়েছে। ফলে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোনো ও অনাবশ্যক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে, যা সমকালীন বিনিয়োগ সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং উদ্ভাবনবান্ধব নয়। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের জন্য ভ্যাট, শুল্ক ও আয়কর আইনের সেবাপ্রাপ্তিতে কোনো ওয়ান স্টপ গন্তব্যও নেই। এর ফলে বিধিমূলক তথ্য যাচাই করতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। এভাবে নীতি ও বিধিবিধানগুলোর ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়নকালে ব্যাপক দ্বিধা ও ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়, যার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব আছে। উল্লিখিত জরিপ অনুযায়ী, ১০০ শতাংশ অংশগ্রহণকারীই মনে করেন যে শুল্কসংক্রান্ত বিধিবিধানে অসামঞ্জস্য বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে।

তথ্যগত অস্পষ্টতা এবং শুরুর প্রাক্কালে প্রাথমিক সমন্বয়হীনতা, স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রয়োগ বা তার ঘাটতি ভয়াবহ প্রতিকূল পরিণাম সৃষ্টি করতে পারে। পর্যাপ্ত নীতিমালা বিধিমূলক আদেশের অদৃশ্য প্রকৃতি নিজের মতো করে ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে। সঠিক কার্যপরিক্রম বিন্যাসের ক্ষেত্রে এসব বিষয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপকভাবে দ্বিধায় ফেলে দেয়। যখন কোনো নতুন ব্যবসায়িক ধারণা মাঠে বাস্তবায়ন হয় এবং তার জন্য সংবিধিবদ্ধ কোনো উপযুক্ত আইনি বিধি থাকে না, তখন আরও বেশি সমস্যা সৃষ্টি হয়।

অধিকন্তু দেশে একটি দুর্বল ও সংশয়পূর্ণ প্রতিকার বা অসন্তুষ্টি প্রকাশের ব্যবস্থা বলবৎ রয়েছে। এই ব্যবস্থায় কোনো ইস্যু ও সুনির্দিষ্ট কিছু বিধির কারণে মুখোমুখি হওয়া জটিলতা সম্পর্কে নিজস্ব মতামত প্রকাশের খুব একটা সুযোগ নেই। এটি ব্যবসায়িক পরিবেশে বিপত্তি সৃষ্টি করে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের (বাধ্য হয়েই) অস্বচ্ছ ও সামঞ্জস্যহীন নীতিমালার মধ্যে নিজেদের ব্যবসা করে যেতে হয় এবং কর্তৃপক্ষের দিক থেকে স্পষ্টীকরণের সব আশা ছেড়ে দিতে হয়।

বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তনের কারণে সামনের বছরগুলোয় যে কোনো প্রকল্প চালিয়ে নেওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। রাজনৈতিক আনুকূল্যপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাবানদের দ্বারা আইনি ভঙ্গুরতার অন্যায্য সুযোগের ব্যবহার এখানে প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। নৈমিত্তিক দৃশ্যপটে অর্থনৈতিক ঝুঁকির অসংখ্য ধরন সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের সতর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি আশাও করা হয়। তথাপি দুর্বল বিধিমূলক অবস্থানের সঙ্গে কারও কারও প্রতি বিশেষ প্রাধিকারমূলক আচরণের উপস্থিতি ব্যবসায়িক পরিবেশে আরও অনিশ্চয়তা ও গোলযোগের শক্তি জোগায়। পরিণামে এটি অনেক ভালো ব্যবসায়ীকে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করা থেকে নিরুত্সাহিত করে।

সম্ভাবনাময়ভাবে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় শামিল হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ৫ থেকে প্রায় ৮ শতাংশের চমকপ্রদ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছে। তবে এখনো লক্ষ্য পূরণ হয়নি। আলোচ্য লক্ষ্য অর্জনে তর্কাতীতভাবে ব্যক্তি খাতের উল্লেখযোগ্য মাত্রার অবদান দরকার হবে। খাতটিকে ব্যাপক কার্যকর রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি খাতের কার্যকারিতার একটি নির্ধারক হলো বিধিমূলক পরিবেশের উন্নয়ন।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক