প্রাণঘাতী ট্রেন দুর্ঘটনা

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়লে তিন নারীসহ চারজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকাগামী আন্তনগর ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস বরমচাল স্টেশন অতিক্রম করে কুলাউড়া আসার পথে রেলপথের একটি কালভার্ট ভেঙে পেছনের পাঁচটি যাত্রীবাহী বগি খালে পড়লে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। আহতদের মধ্যে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬২ জন। মারাত্মক আঘাত থাকায় ২০ জনকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পর ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও গতকাল সকালে তা ফের শুরু হয়।

তুলনামূলক নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচনা করে মানুষ ট্রেনে ভ্রমণ করতে আগ্রহী হয়। কিন্তু সেই ট্রেনে যদি একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? গত বছর ট্রেনে কাটা পড়ে কয়েক শ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যদিও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এর জন্য নাগরিকদের অসচেতনতাকে দায়ী করেছে। কিন্তু কুলাউড়ার ঘটনায় যাত্রী বা সাধারণ মানুষের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই। রেলওয়ে সচিব বলেছেন, দুর্ঘটনাটি গুরুতর। কিন্তু কীভাবে এমন দুর্ঘটনাটি ঘটল এবং এর জন্য কারা দায়ী, তা আদৌ জানা যাবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় কাটানো কঠিন। অতীতে এ ধরনের দুর্ঘটনায় খুব কম ক্ষেত্রেই দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তাঁদের তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি সেতু ভেঙে যাওয়ায় ছয় দিন ধরে ঢাকা-সিলেট রুটে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ আছে। ফলে ঢাকা-সিলেট রুটের ওই ট্রেনটিতে যাত্রীদের ভিড় অনেক বেশি ছিল। অন্যদিকে, কুলাউড়া থেকে ট্রেন ছাড়তে দেরি হওয়ায় চালক নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে ট্রেনের গতিও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অতিরিক্ত যাত্রী ও অতিরিক্ত গতির কারণেই কালভার্টটি ভেঙে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কালভার্টের সামনে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি ছিল—সর্বোচ্চ সীমা ২০ কিলোমিটার। কিন্তু সে সময় ট্রেনের গতি ৮০ কিলোমিটার বা এর কাছাকাছি ছিল বলে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের যাত্রীরা জানিয়েছেন। তাই এ দুর্ঘটনার দায় কোনোভাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। ট্রেন দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ দাবি মোটেই অযৌক্তিক নয়।

 রেলওয়ের সর্বত্র অনিয়ম ও দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। ঢাকা-সিলেটসহ রেলওয়ের বিভিন্ন রুটে যেসব সেতু ও কালভার্ট আছে, সেগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয় কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। রেললাইন থেকে ক্রসিং পয়েট সবটাই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। রেলওয়ের একজন সাবেক মন্ত্রী রেলওয়ের কালো বিড়াল ধরতে গিয়ে নিজেই ধরা খেয়েছিলেন। নতুন রেলমন্ত্রী রেলওয়েকে ঢেলে সাজানোর কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। বরং গত ঈদে ট্রেনের সময়সূচি বিপর্যয়ের কারণে যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়েছিল। এভাবে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।

সবশেষে আরেকটি সামাজিক বাস্তবতার প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার বলে মনে করি। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এলাকাবাসী দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করেছেন, তঁারা মাইকিং করেও এলাকার লোকজনকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই সুযোগে স্থানীয় কতিপয় দুর্বৃত্ত দুর্ঘটনাকবলিত বগিগুলো থেকে যাত্রীদের মালামাল চুরি করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই নৈতিক অবক্ষয় থেকে উদ্ধারের উপায় কী!