বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য দৌড়ের সংস্কৃতি

দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৯। শিক্ষা কার্যক্রম চলছে ৪৫ টিতে। সংখ্যা হিসাবে নেহাত কম নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিত্যদিনই লাউঞ্জ কিংবা ক্লাবের আড্ডায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খালি হবে হবে’ থাকা উপাচার্য, সহ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ পদ নিয়ে কথাবার্তা শোনা যায়। কারা কারা এই পদগুলোর জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন, কোথায় কোথায় ধরনা দিচ্ছেন সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর মধ্যে সবচেয়ে দামি উপাচার্য পদটি। আবার কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে কিছুটা গলার স্বর পরিবর্তন করে বলেন, তাঁরা সরকারের পক্ষ থেকে উপাচার্য হওয়ার যোগ্য হিসেবে ‘অফার’ পেয়েছেন, কিন্তু তাঁরা আগ্রহী নন বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আবার যাঁরা দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা বেশির ভাগই বলেন, ‘তাঁরা ছেড়ে দিতে চান কিন্তু সরকার পক্ষের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারছেন না’, তাই দ্বিতীয় মেয়াদ সেই অনুরোধেরই অবদান। একেবারে হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া কেউই বলেন না এই অতি লোভনীয় উপাচার্য পদে যাওয়ার জন্য তাঁদের তদবির বা লবিংয়ের কথা, বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়ে, কখনো কখনো আঞ্চলিকতাকে কাজে লাগিয়ে কিংবা ‘এত দিনেও কিছু পাইনি আমি’জাতীয় বাক্যকে বাজারজাত করে সেই পদটি বাগিয়ে নেওয়ার কথা। বেশির ভাগই বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। হঠাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ফোন পেয়েই জানতে পেরেছেন। এই রকম গল্প যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা নিজেরাও হয়তো এই রকম ‘অতি চমকে’ দেওয়ার ফোন পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন বলে মনে হয়। তবে এ ধরনের গল্প বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা একেবারেই সীমিত।

কয়েক মাস ধরে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে আসীন হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যে ধরনের তৎপরতা এবং প্রতিযোগিতা দেখা গেছে, তা কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। অথচ এই বছর দশেক আগেও বোধ হয় বিষয়গুলো এই রকম ছিল না। দিনে দিনে এটি দৌড় প্রতিযোগিতার মতো হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত অর্থাৎ এগুলো’ ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলার কথা। এ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী যেভাবে উপাচার্য নিয়োগের বিধান আছে, তা সাধারণত পালন করা হয় না। নিয়মিত সিনেট নির্বাচন দেওয়ার কথা থাকলেও সে নির্বাচনও যথার্থভাবে নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠিত হয় না। সিনেটকে সক্রিয় রাখতে হলে যেভাবে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের নির্বাচন করার কথা, সেটিও অনুসরণ করা হয় না। ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচন করে সেখান থেকে মাননীয় আচার্যের একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে উপাচার্য পদে আসীন ব্যক্তিও পরিবর্তিত হয়। একবার কেউ উপাচার্য হলে সেখান থেকে নড়তে চান না। চার বছর পার হলেও আবারও সেই পদে থাকতে চান। মজার বিষয় হলো সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঘিরে যে ক্ষমতাবান বা শিক্ষক রাজনীতিতে হেভিওয়েট বলে খ্যাত শিক্ষকদের শক্ত সিন্ডিকেটের দম্ভ গাড়েন, যাঁরা উপাচার্যকে বিপদে-আপদে আগলে রাখেন-থাকেন, তাঁদের অনেকেই আবার ভিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কিংবা অন্য কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংকেত পেলেই সেই উপাচার্য হটিয়ে কীভাবে নিজেরা উপাচার্য হতে পারবেন, সে জন্য আদাজল খেয়ে লেগে পড়েন।

তবে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, উপাচার্য পদে আসীন হতে সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ধরনের সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে সেটি। প্রার্থীরা যে নিজেদের সম্পর্কে জোরালো তদবির করেই ক্ষান্ত থাকেন তা নয়, অন্য প্রার্থীদের দোষের পাল্লা খুলে সেগুলো সরকারের নীতিনির্ধারক উচ্চমহলে প্রচারের ব্যবস্থা করেন এবং সম্ভাব্য নারী প্রার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের দোষক্রটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।

আসলে এই উপাচার্য পদে কী কী ধরনের ক্ষমতার মধু আছে? তবে ‘কিছুমিছু’ যে আছে, তা এই পদে আসীন শিক্ষকদের তদবির লাইন এবং আকাঙ্ক্ষার উচ্চতা মাপলেই বোঝা যাবে। তা ছাড়া গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্যও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে এ কথা এখন সবাই একবাক্যে মেনে নেবেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য হতে একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতার মাপজোখ হয় না। সরকারি দলে শতভাগ আনুগত্য প্রদর্শন, শক্ত তদবির এবং হালে প্রাধান্য পাওয়া আঞ্চলিক রাজনীতি গুরুত্ব পায়। এ প্রতিযোগিতায় আরও ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পান উপাচার্য প্রার্থীর পক্ষীয় নেতা, সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীরাও।

এখন শিক্ষাব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার্থীদের ওপর এর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে? শিক্ষার্থীরা জানছেন তাঁদের কোন কোন শিক্ষক নিজে পড়াশোনা, গবেষণা কিংবা পড়ানোর বাইরে পদ-পদবি হাতড়াতে ব্যস্ত। শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার চেয়ে তাঁদের তাগাদার চাকা এখন নীতিনির্ধারকদের রুমের দিকে। শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাঁরা তাঁদের সমস্ত মেধা, শক্তি বিনিয়োগ করছেন, তাঁরা সহকর্মীকে হেয় করে, একে অন্যের বিরুদ্ধে নোংরা কথাবার্তা, উড়োচিঠি দিচ্ছেন। সেই শিক্ষকেরা যখন শ্রেণিকক্ষে যাবেন, তখন শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হওয়াটা নিশ্চিতভাবেই তাঁদের জন্য কঠিন। হয়তো তাঁরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান না, কারণ তাঁদের মাথা তো এখন অন্যদিকে ঝুঁকে আছে।

এই সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব? সঠিক সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সিনেটকে সক্রিয় করে সিনেট সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত তিন সদস্যের প্যানেল থেকে উপাচার্য নির্বাচনের ধারাবাহিক সংস্কৃতি চালু করা কি আসলেই সমস্যার? হ্যাঁ, সমস্যা আছে, সেটি মনে হয় সরকারের দিকনির্দেশনার। সরকারের মনোভাব অক্ষরে অক্ষরে বোঝা এবং পালন করার ওপরেই নির্ভর করে উপাচার্যদের ক্ষমতার কেদারা। তাই রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সিনেট নির্বাচন দেওয়া না–দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখানে ভয় থাকে সরকারের। সিনেট সদস্যরা যদি ভোট দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম সমর্পণে আগ্রহী শিক্ষকদের নির্বাচিত করেন, তাহলে সরকার বিপদে পড়তে পারে।

কিন্তু এই উপাচার্য দৌড়ের সংস্কৃতি চলতে থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক মান নিয়ে জারি থাকা শাখা-প্রশাখা বিস্তারকারী প্রশ্নগুলো অচিরেই বটগাছ হয়ে যাবে, আর তার ছায়ায় বসেই একবারেই বিশ্রামে চলে যাবে পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটিই।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
zobaidanasreen@gmail. com