যশোর-কুষ্টিয়ায় অনাবাদি জমি

প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে—নিউটনের এই তৃতীয় সূত্র যে দেশের ধান আবাদের ওপরও ভর করবে এবং আউশ চাষে কৃষক আগ্রহ হারাবেন, তা বোরো ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ার পরই স্পষ্ট হয়েছিল। এরপরও সরকারের সদিচ্ছা ও কার্যকর পদক্ষেপ ধানের আবাদকে তৃতীয় সূত্রটির ‘আসর’ থেকে রক্ষা করতে পারত। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যার ওপর ভরসা করে কৃষক আবাদে মনোযোগী হতে পারেন।

এই মুহূর্তের মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা হলো, বাম্পার ফলনের পরও বোরোর দাম না পাওয়ায় কৃষকের বুকে তুষের আগুনের মতো যে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে, আউশ আবাদে তার তপ্ত আঁচ লাগতে শুরু করেছে। একদিকে ন্যায্য দাম না পাওয়ার আশঙ্কা, অন্যদিকে সেচের খরচ বাড়ার ভয়—সব মিলিয়ে আউশ আবাদে আগ্রহ হারিয়েছেন কৃষকেরা। বিশেষ করে যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলের ছয় জেলার কৃষকদের অনাগ্রহ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করার মতো। এ অঞ্চলের ২ লাখ ১৫ হাজার ৩৬ হেক্টর চাষযোগ্য জমি কৃষকেরা ফেলে রেখেছেন। সেখানে পাট অথবা আউশ আবাদের কথা থাকলেও এবার জমিগুলো ‘ছুটি কাটাচ্ছে’। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্প থেকে চলতি মৌসুমে কৃষক সময়মতো প্রয়োজনীয় পানি পায়নি। বৃষ্টিপাতও এ বছর তুলনামূলক কম। খরায় পুড়ছে মাঠ। ফলে সেচ খরচ বাড়ার ভয় বেড়েছে।

পাউবো কুষ্টিয়ার একজন কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘ওই সময়ে সেচপাম্প বন্ধ রেখে বার্ষিক মেরামতের কাজ করা হয়েছে। যে কারণে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।’ অর্থাৎ বার্ষিক ‘মেরামতের কাজ’ করার আর কোনো সময় পাওয়া গেল না, বেছে বেছে আউশের সেচের আসল সময়টাতেই এই কাজ করা হলো। এতে মাঠে কৃষক কম খরচে সেচের পানি পাননি। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা যে বার্তাটি পেলেন, সেটি হলো ধান আবাদের বিষয়ে সরকার তাঁদের পাশে নেই, যা করার তা তাঁদের নিজেদেরই দায়িত্ব নিয়ে করতে হবে। সরকারের এই গা ছাড়া মনোভাব তাঁদের আউশ আবাদে অনাগ্রহী করবে—সেটাই স্বাভাবিক।

নিউটনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সূত্র অনুযায়ী, এর পরের ধাপে যা ঘটবে তা হলো, মাঠ পতিত থাকায় ফসল তোলার মৌসুমে আউশ পাওয়া যাবে না। তখন দাম হবে দ্বিগুণ বা তারও বেশি। সরকারি গোলায় টান পড়বে। সরকার গুদাম ভরতে অনেক বেশি টাকায় ধান কেনা শুরু করবে। বরাবরের মতোই কৃষকের কাছ থেকে কম টাকায় ধান কিনে সেই ধান মধ্যস্বত্বভোগী মিলমালিক ও ফড়িয়ারা কৌশলে সরকারের কাছে বিক্রি করবেন। পুরো প্রক্রিয়াটির দিকে তাকালে বোঝা যায়, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য ধানের আবাদ ও বাজার ব্যবস্থাপনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা যতক্ষণ সক্রিয় থাকছে, ততক্ষণ এ দেশে ধানের আবাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।