নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন

সাত-আট বছর আগে মালদ্বীপ যাচ্ছি একটি আঞ্চলিক মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য হিসেবে। সেখানকার রাজনৈতিক অচলাবস্থার ওপর তথ্যানুসন্ধান করার কাজে। যাওয়ার আগে মালদ্বীপের সংবিধান পড়লাম ভালো করে। বিমানে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন আমাদের দলটির প্রধান ড. কামাল হোসেন। তাঁকে বললাম, মালদ্বীপের সংবিধানটা অসাধারণ, পৃথিবীর সব ভালো ভালো বিধান ঠেসে ঢোকানো হয়েছে সেখানে। তিনি হাসলেন, বললেন, সেটা বড় কথা না, আসল কথা হচ্ছে তার প্রয়োগ। তিনি কিছু আফ্রিকান দেশের উদাহরণ দিয়ে বললেন, ভালো ভালো চুক্তি আর আইন করেছে তারা, কিন্তু কোনো বাস্তবায়ন নেই। শুধু আইন পড়লে তাই ভুল ধারণা পায় মানুষ।

তাঁর এ কথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভালো ভালো আইনের অভাব নেই এ দেশে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। নির্যাতন-সংক্রান্ত আইন এর একটি বড় উদাহরণ। এ দেশের সংবিধান, আইন, আদালতের রায়—সবই নির্যাতনবিরোধী। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। নির্যাতনের ভয়াবহ খবর প্রকাশিত হয় না, এমন একটি দিন পাওয়া বিরল। অথচ নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কারও শাস্তি হয়েছে, এমন সংবাদ কখনো প্রকাশিত হয়েছে কি না, সন্দেহ।

নির্যাতন নিয়ে আইনি ব্যবস্থার পেছনে যে সদিচ্ছা নেই কোনো, তার একটি বড় প্রমাণ পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের ঢিলেঢালা অংশগ্রহণ দেখলে। সাদামাটা চোখে দেখলে মনে হবে, কথাটি ঠিক নয়। একমাত্র গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তি ছাড়া নির্যাতনবিরোধী প্রায় সব আন্তর্জাতিক চুক্তির সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশ। কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সেখানেও রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি।

২.
নির্যাতনবিরোধী (নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অমর্যাদাকর আচরণ ও শাস্তির বিরুদ্ধে চুক্তি) সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক চুক্তিটি প্রণীত হয় ১৯৮৪ সালে। এই চুক্তি অনুসারে, সদস্যরাষ্ট্রগুলো নির্যাতনমূলক আচরণ নিবারণ, বন্ধ ও শাস্তিযোগ্য করবে এবং মানুষকে সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন থেকে রক্ষার জন্য সব উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে। নির্যাতনবিরোধী চুক্তির উল্লেখযোগ্য একটি বিধান হচ্ছে এর ১৪ অনুচ্ছেদ। এতে বলা আছে, প্রতিটি রাষ্ট্র তার আইনব্যবস্থায় এটি নিশ্চিত করবে যে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবার উপযুক্ত প্রতিকার পেয়েছে এবং পরিপূর্ণ পুনর্বাসনসহ তার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার আছে। ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ চুক্তিটির পক্ষ হওয়ার সময় ঘোষণা দেয় যে সে অনুচ্ছেদটি তার নিজস্ব আইন অনুসারে প্রয়োগ করবে।

দৃশ্যত, এই ঘোষণা বা ডিক্লারেশনের উদ্দেশ্য ছিল নির্যাতনবিরোধী বৈশ্বিক মানদণ্ড এড়িয়ে যাওয়া। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৯৯ জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জার্মানি বাংলাদেশের এই ঘোষণার প্রতি আপত্তি জানায়। জার্মানির মন্তব্য হচ্ছে: এই ঘোষণা চুক্তিটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি বাংলাদেশের অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। ২০ ডিসেম্বর ১৯৯৯ একই রকম আপত্তি জানিয়ে নেদারল্যান্ডস মন্তব্য করে, এই ঘোষণা আন্তর্জাতিক চুক্তি আইনের প্রতি অবমাননামূলক।

নির্যাতনবিরোধী চুক্তিটির প্রতি বাংলাদেশের অনান্তরিক মনোভাব ফুটে ওঠে এই চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নজরদারি পদ্ধতিগুলো এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি।

প্রতিবেদন পেশ: বাংলাদেশ নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষ হয়েছে ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর। কাজেই বাংলাদেশের দায়িত্ব ছিল এর ১৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে চুক্তির পক্ষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে (এবং এরপর প্রতি চার বছর অন্তর) একটি প্রতিবেদন চুক্তিটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নির্যাতনবিরোধী কমিটির কাছে জমা দেওয়া। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী যাতে নির্যাতন না করে এবং নির্যাতন করলে কী শাস্তি পাবে এবং দেশের সংবিধান, আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় এগুলো নিশ্চিত করার কী কী ব্যবস্থা রয়েছে তার বিশদ বিবরণ দেওয়ার দায়দায়িত্ব ছিল। চুক্তির পক্ষ হওয়ার পর ২১ বছর পেরিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রথম প্রতিবেদনটিই জমা দেয়নি। শোনা যাচ্ছে, এ বছর ২৬ আগস্ট অনুষ্ঠিতব্য কমিটির ৬৭ তম বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার আগে তড়িঘড়ি করে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

চুক্তির অন্যান্য নজরদারি: নির্যাতনবিরোধী চুক্তিতে কোনো সদস্যরাষ্ট্রের ওপর নজরদারির জন্য আরও তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্য কোনো সদস্যরাষ্ট্র (অনুচ্ছেদ ২১) এবং/বা নিজ রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে (অনুচ্ছেদ ২২) কমিটির কাছে অভিযোগ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সদস্যরাষ্ট্রকে আলাদাভাবে সম্মতিমূলক ঘোষণা দিতে হয়। বাংলাদেশ একটি ঘোষণাও দেয়নি। কমিটি কর্তৃক নিজে থেকে তদন্ত ও তদন্তের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট দেশে পরিদর্শন (অনুচ্ছেদ ২০) করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে রাজি হতে হয়। অন্যান্য দায়দায়িত্ব পালনে অনীহা থেকে মনে হয় না বাংলাদেশ কখনো এতে রাজি হবে।

নির্যাতনবিরোধী ঐচ্ছিক প্রটোকল: নির্যাতন নিবারণ বা হওয়ার আগেই এর সম্ভাবনা রোধ করার লক্ষ্য নিয়ে এই প্রটোকল প্রণীত হয়। এতে প্রতিটি রাষ্ট্রকে তার নিজস্ব নির্যাতন নিবারণব্যবস্থা গড়ে তোলার তাগিদ দেওয়া হয়। এতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক আটক রাখার প্রকাশ্য ও গোপন স্থানগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনের অধিকার দেওয়া হয় বেসরকারি পর্যায়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

২০০২ সালে প্রটোকলটি প্রণীত হয় এবং ২০০৬ সালে কার্যকরী হয়। ১০ জুন ২০১৯ পর্যন্ত এর সদস্যরাষ্ট্র ৮৯। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আফ্রিকার বেশ কিছু রাষ্ট্র থাকলেও বাংলাদেশ এখনো এটির সদস্য হয়নি। ফলে বাংলাদেশ নির্যাতনবিরোধী চুক্তির সদস্যরাষ্ট্র হলেও এ দেশে এর বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক নজরদারির সুযোগ খুব সীমিত বলা যায়।

৩.
আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ দুর্বল হলেও তার নিজের আইনে নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্ত বিধান রয়েছে। নির্যাতন থেকে মুক্তি বাংলাদেশের সংবিধানের অন্তত তিনটি অনুচ্ছেদ অনুসারে (৩১,৩২, ৩৫) মৌলিক একটি অধিকার। অনুচ্ছেদ ৪৪ ও ১০২ অনুসারে এটি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য অধিকার। এরপরও ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৭ ও ১৬৭ ধারার অপপ্রয়োগ করে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার ও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদকালে যেকোনো ধরনের নির্যাতন রোধ করার জন্য কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। প্রায় এক যুগ আগে এ-সংক্রান্ত প্রথম রায়টি দেওয়া হলেও নির্যাতনের ভয়াবহতা বরং বেড়েছে পরে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সাম্প্রতিক রিপোর্টে এর বহু নজির আছে।

বাংলাদেশ ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ করার জন্য একটি আইন করেছে। এখন পর্যন্ত এই আইনে কারও শাস্তি হয়নি, এমনকি এই আইনে মামলা দিতে গেলেও নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ৬ আগস্ট ২০১৪ সালে এ-সংক্রান্ত একটি মামলা ঢাকার মেট্রোপলিটন সেশনস আদালতে দায়ের করা হলেও আজও এর নিষ্পত্তি হয়নি। নিষ্পত্তি হয়নি এই আইনে দায়েরকৃত আরও কয়েকটি মামলার, যদিও আইনটিতে বিধান রয়েছে সর্বোচ্চ ১২০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার। কেন এমন একটি আইন থাকা সত্ত্বেও বিচার হচ্ছে না, তা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত বা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কোনো প্রশ্ন তোলেনি। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো বিশদ গবেষণাও করে দেখেনি। ২০১৮ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিবেদনে অবশ্য আইনটি বাস্তবায়নের ঘাটতির জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অসচেতনতাকে দায়ী করা হয়েছিল।

৪.
আজ ২৬ জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে নির্যাতনবিরোধী দিবস। দিবসটির লক্ষ্য নির্যাতনবিরোধী চুক্তিটির বাস্তবায়নের তাগিদ তুলে ধরা। বাংলাদেশের জন্য এটি বাস্তবায়নের সবচেয়ে জোরালো পথ হতে পারে দেশটির নিজস্ব সাংবিধানিক বিধান ও বিশেষ করে ২০১৩ সালের আইনটি শক্তভাবে প্রয়োগ করা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, শুধু আইন করে ফেলে রাখলে কোনো লাভ নেই। এতে বরং আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের হতাশা বাড়ে।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক