এদিকে ধান ও পাশে সবজি আর ওই গ্রামে টার্কি

আপনি যদি কুষ্টিয়ার গ্রামাঞ্চলের লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, লালশাক, পালংশাকের রান্না তরিতরকারি খেয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, এমন স্বাদের সবজি আর হয় না। শুধু তা-ই না, হাতের কাছে পাবেন বেবি তরমুজ। দেখতে ঘন সবুজ। আর ভেতরে টকটকে লাল। এবং অসম্ভব মিষ্টি। একজন কৃষক বললেন, রাসায়নিক সার বা কীটনাশক-দূষণ নেই। জৈব সারই বেশি ব্যবহার করেন। সে জন্যই এত স্বাদের! সাখাওয়াত সাহেব নিজে চাষাবাদ করেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের গ্রামের খামারে পাবেন টার্কি। ওই যে দেখুন, ওই বাড়ির আঙিনায় তারের বেড়ায় তৈরি একটা ছোট্ট ঘরে ডজনখানেক টার্কি। স্বাদ অসাধারণ। মুরগির গোশতের চেয়েও মজা। দামে সস্তা। বাজারে কাটতি ভালো। ক্রেতার লাভ। খামারিরও লাভ। আবার ওই যে দেখুন ওই পাশে গড়ে উঠেছে কুষ্টিয়া অঞ্চলের বিশ্বখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের খামার। এর মাংস যেমন সুস্বাদু, চামড়া তেমনি বিশ্ববাজারে সমাদৃত। খামারটি আসলে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের মূল প্রজাতির ছাগল প্রজননকেন্দ্র। সেখানে গবেষণাও চলে। এদিকে আছে ধানের আবাদ। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) সহযোগিতা দিচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কুষ্টিয়ায় সুপরিচিত বেসরকারি সংস্থা দিশা।’

কুষ্টিয়ার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখলাম, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এখন নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কত আশাবাদী। কত বৈচিত্র্যময় ও বহুমাত্রিক উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামগুলো। মূল শহরের কাছেই। মিরপুর উপজেলার চরপাড়া, বারুইপাড়া, বলিদাপাড়াসহ কয়েকটি ইউনিয়নের কৃষক এখন শুধু চাষাবাদ আর খামারেই ধনী না, শিক্ষা-চিকিৎসা, নিঃস্ব প্রবীণদের বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প—সবকিছুই তাঁদের হাতের কাছে। এই গ্রামগুলোতে তামাক চাষই ছিল প্রধান। এখনো তা-ই, তবে কমতে শুরু করেছে। সেখানে কাজ শুরু করেছে দিশা। ওরা গ্রামের কৃষকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। পাশাপাশি পিকেএসএফের সহায়তায় কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মানবকেন্দ্রিক কর্মসূচি, যা সমৃদ্ধি নামে পরিচিত।

এটা হলো মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে গরিব পরিবারগুলোর সম্পদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম। গ্রামের একজন সাধারণ গরিব কৃষক বা তাঁর পরিবারের সদস্য এই সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় সব ধরনের সেবা পান। মায়ের পেটে ভ্রূণাবস্থা থেকে শুরু করে তার জন্ম, বড় হওয়া, তার পড়ালেখা, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন—সবকিছুই সমৃদ্ধি কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত হয়। এটা দান-খয়রাতি কার্যক্রম নয় বা শুধু একতরফা ঋণ কর্মসূচি নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে গরিব পরিবারের সদস্যের সাধ্যের আওতায়, ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে নিজস্ব সঞ্চয়ের সঙ্গে ঋণসহায়তা যোগ করে উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়াই হলো সমৃদ্ধি কর্মসূচির মূল বৈশিষ্ট্য।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া থেকে নানা কারণে ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষা অব্যাহত রাখারও কর্মসূচি রয়েছে। বলা যায়, গ্রামের কেউ এখন আর শিক্ষাবঞ্চিত নয়। এটা বড় সাফল্য। ২০০-এর বেশি ইউনিয়নে সমৃদ্ধি কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। দিশা মিরপুর উপজেলায় এ কর্মসূচি চালাচ্ছে তিনটি ইউনিয়নে। সমৃদ্ধি কর্মসূচি প্রতিটি ইউনিয়নে বড় সাফল্য অর্জন করেছে। গ্রামের গরিব মানুষ নিজেদের সম্পদ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে আস্থাশীল হয়ে উঠেছে। ক্রমেই এই কর্মসূচি দেশের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

ওই অঞ্চলের কৃষক আগে শুধু তামাক চাষ করতেন। তামাক চাষের কারণে গ্রামের সবাই যে ভয়াবহ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়, সে ব্যাপারে কৃষকেরা সচেতন ছিলেন না। তামাক চাষের কারণে ফুসফুস নষ্ট হয়, অনেকে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। স্ত্রী, ছেলেমেয়েরাও আক্রান্ত হয়। গ্রামে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাহলে কেন গ্রামের মানুষ তামাক চাষে যায়? এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আসলে কৃষক সবই জানেন। কিন্তু তামাক চাষে তাৎক্ষণিক লাভ বেশি বলে তাঁদের একটি ধারণা। তাই তাঁরা তামাক চাষে যান। মহাজন অগ্রিম টাকা দিয়ে কৃষকদের তথাকথিত চুক্তির জালে বাঁধেন। কৃষক ফসল ওঠার আগেই নগদ টাকা পান। এটাই তাঁদের আকর্ষণ। কিন্তু পরে উৎপন্ন তামাক তাঁরা নির্দিষ্ট মহাজনের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য থাকেন। তাঁদের পণ্যের দাম নির্ধারণের সময় শুরু হয় টালবাহানা। নিম্ন মান, মধ্যম মান প্রভৃতি বিভিন্ন ভাগে ফেলে তাঁদের উৎপন্ন তামাকের দাম কমিয়ে ধরেন। তখন আর কৃষকের কোনো ওজর-আপত্তি খাটে না। এভাবে কৃষক ঠকেন। আর ওদিকে তামাক চাষের কারণে অসুখ-বিসুখে জর্জরিত হন।

দিশা ও পিকেএসএফের সহায়তায় ওই এলাকার কৃষকেরা বিকল্প লাভজনক সবজি চাষ শুরু করেন। তাঁদের উন্নত মানের বীজ, সার, সেচ প্রভৃতির ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় দিশা। এখন তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে সবজির চাষাবাদ এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাঁদের স্ত্রীদের কাজের সংস্থানও করা হয়। আগে তাঁদের দিন-রাত তামাক পাতা আগুনের তাপে শুকাতে হতো। চোখ নষ্ট হতো। ফুসফুস আক্রান্ত হতো। এখন তাঁরা ওই সব অসুখ-বিসুখমুক্ত। তাঁদের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত এলাকার প্রায় ২০০ কৃষক তামাক চাষ থেকে সরে এসে বিকল্প লাভজনক চাষের কাজে যুক্ত হয়েছেন।

তামাক চাষের কারণে ইতিমধ্যে বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী হয়ে কৃষক পরিবারের যারা ধুঁকে ধুঁকে মরছিল, তাদের সুচিকিৎসার জন্য স্থাপন করা হয়েছে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। সেখানে বৃদ্ধ ও অসুস্থ মা-বাবা, প্রসূতি নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়। এই কর্মসূচির মূল বৈশিষ্ট্য হলো পরিপূরক প্রকল্প গ্রহণ ও সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন। একদিকে লাভজনক চাষাবাদ, অন্যদিকে টার্কি পালন। ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের উৎকর্ষ সাধন ও বাণিজ্যিকভাবে গরু-ছাগল পালন প্রভৃতি। অন্যদিকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, গরিব মানুষকে উপার্জনক্ষম করে তোলার কাজ।

আরেকটি দিক হলো, এই বিশাল এলাকায় গ্রামের পর গ্রামজুড়ে রয়েছে পাকা রাস্তা। এটা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগ। দিশা সেখানে স্থানীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি হয়েছে। এলাকার কৃষক এখন সহজে তাঁদের উৎপন্ন পণ্য বাজারজাত করতে পারেন। অন্যদিকে পুরো এলাকায় রয়েছে বিরতিহীন বিদ্যুৎ। উন্নয়নের চাবিকাঠি। বিদ্যুৎ ছাড়া এত বড় বড় প্রকল্প সফল করা কঠিন।

পিকেএসএফের সমৃদ্ধি কর্মসূচি একটি সফল উদ্যোগ। দিশা ও অন্যান্য এনজিওর মাধ্যমে এই প্রকল্প দেশের সব গ্রামে নিয়ে যাওয়া দরকার।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]