'অর্থ' ঢাললেই ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান মিলবে না

ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ছাড়া ফিলিস্তিনিদের সমস্যার কোনো দিন সমাধান হবে না। ছবি: রয়টার্স
ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ছাড়া ফিলিস্তিনিদের সমস্যার কোনো দিন সমাধান হবে না। ছবি: রয়টার্স

বাহরাইনের রাজধানী মানামায় গতকাল মঙ্গলবার শুরু হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত এক অর্থনৈতিক কর্মশালা, যেখানে আরব ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছেন। দুই দিনের এই কর্মশালায় গাজাসহ ফিলিস্তিন অধিকৃত অঞ্চলগুলোর জন্য নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করার কথা। যদিও আমাদের এটা দেখে অবাক হওয়া উচিত হবে না যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন ধনী শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি কোনো একটি সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থ ঢালতে চাইছেন। কিন্তু এটা দেখা খুব হতাশাজনক যে অনেকেই সত্যিই বিশ্বাস করেন যে সাধারণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের কয়েক দশকের সমস্যার সমাধান করবে। জটিল রাজনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা ছাড়া কোনো ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি জনগণের কোনো উপকারে আসবে না।

এটা সবার কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত যে একটি দখলকৃত অর্থনীতি কখনোই ‘সঠিক পথে যেতে পারে না’ এমনকি এই খাতে যদি শত শত কোটি টাকাও ঢালা হয়। ফিলিস্তিন একসময় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এরপর তাদের একের পর এক ফিলিস্তিনের ভূমি দখলের ফলে সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। অসলো চুক্তির অংশ হিসেবে ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকে স্বাক্ষরিত বেশ কয়েকটি শান্তিচুক্তির আওতায় ফিলিস্তিনের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে আসে।

১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস প্রটোকল ফিলিস্তিনের অর্থনীতির বিশেষভাবে ক্ষতি করেছে। এই প্রটোকল ইসরায়েলের পণ্যগুলোকে সরাসরি ফিলিস্তিনের বাজারে প্রবেশাধিকার দেয়, কিন্তু ইসরায়েলের বাজারে ফিলিস্তিনি পণ্যের প্রবেশাধিকার বাধা দেয় না। এই প্রটোকল ইসরায়েলকে কর সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় এবং ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে ইসরায়েলি মুদ্রা শেকেল ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। এর ফলে নতুন করে গঠিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ বা কোনো অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করার আর সুযোগই রইল না। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে গেল ইসরায়েলের হাতে।

গাজার ৩৫ শতাংশ কৃষিজমি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্ধারিত তথাকথিত ‘বাফার জোনে’ পড়েছে। এসব জমিতে চাষাবাদ করার সুযোগ খুবই কম। গাজার অন্যান্য কৃষিভূমিতে নির্দিষ্ট সময়ের বিরতিতে ইসরায়েলি বিমান থেকে আগাছানাশক ছিটানো হয়। যার ফলে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ফিলিস্তিনের ১৩ লাখ ডলার ক্ষতি হয়েছিল।

পশ্চিম তীরের এরিয়া সি এলাকার জমি উর্বর, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং সেগুলো ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। এই এলাকার পরিধি গোটা পশ্চিম তীরের ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে জর্ডান উপত্যকার ৯৫ শতাংশ এলাকা। ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা এখানে ব্যাপক চাষাবাদ করে থাকে।

ফিলিস্তিনের বেশির ভাগ অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে এবং তারা চাইলে এসব অবকাঠামোয় ফিলিস্তিনিদের প্রবেশাধিকার সীমিত করতে পারে। কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মোবাইল সেবার ওপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আসছে। তারা সেখানে থ্রি–জি প্রযুক্তি চালুর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে থ্রি–জি প্রযুক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ২০১৩ থেকে ২০১৫ সময়ে ফিলিস্তিনের মোবাইল অপারেটরদের ৪৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার থেকে এবং দেড় শ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছিল।

ইসরায়েল দৈনন্দিন ভিত্তিতে পশ্চিম তীরের বিভিন্ন সড়ক ও পাসে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অধিকৃত ভূমিতে অসংখ্য ইসরায়েলি চেকপয়েন্টের কারণে ফিলিস্তিনের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব চেকপয়েন্টের কারণে ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনের জিডিপি ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। আসলে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের কৃষি ও উৎপাদন শিল্পকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। আর এ কারণে এখানকার মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশই বেকার। এ ছাড়া ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিয়মিত বোমা চালিয়ে এই ভূখণ্ডের মৌলিক অবকাঠামোগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। জাতিসংঘের মতে, এভাবে যদি বোমা হামলা চলতে থাকে, তাহলে ২০২০ সালের মধ্যে গোটা ফিলিস্তিন বসবাসের অযোগ্য অঞ্চলে পরিণত হবে।

অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধের যৌথ প্রভাবে ফিলিস্তিনের অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থা। ফিলিস্তিনিদের কাছে এটা পরিষ্কার যে এই সাধারণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তাদের দমনের আরেকটি পদক্ষেপ। আসলে ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ছাড়া ফিলিস্তিনিদের সমস্যার কোনো দিন সমাধান হবে না। এটা সব ফিলিস্তিনি বুঝে গেছে। তাই মার্কিন মধ্যস্থতায় বাহরাইনের বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। বর্ণবাদ উত্তর–দক্ষিণ আফ্রিকায়, অর্থনীতি থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার কারণে স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে অর্জন করা যায়নি। ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। আগে তাদের রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের রাজনৈতিক অধিকার যতক্ষণ অস্বীকার করা হচ্ছে, ততক্ষণ তাদের ‘অর্থনৈতিক শান্তি’ আসবে না।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইয়ারা হাওয়ারি: দ্য প্যালেস্টাইন পলিসি নেটওয়ার্ক আল–শাবাকার ফেলো