ধানচাষির দুঃখ ঘুচবে কীভাবে

কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতির ফলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়
কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতির ফলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়

বাংলাদেশে গত তিন-চার দশকে জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এর ফলে ছোট্ট এই দেশে খাদ্যাভাব অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কারণ, আমাদের ফসল ফলানোর উপযোগী জমির পরিমাণ জনসংখ্যার তুলনায় খুবই কম। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজমির পরিমাণ ইতিমধ্যে অনেক কমেছে এবং আরও কমে যাচ্ছে। কিন্তু সে জন্য আমাদের খাদ্যাভাব বাড়েনি, বরং অনেক কমে গেছে। প্রাণ ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব আজ আর নেই। বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলে আজ আর কেউ স্রেফ অনাহারে মারা যায় না। উত্তরবঙ্গের মর্মান্তিক মঙ্গার অবসান ঘটেছে।

এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে কৃষিব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতির ফলে। বিশেষত, ধানের উৎপাদন বেড়েছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। একসময় এক বিঘা জমিতে ৭-৮ মণের বেশি ধান ফলত না, কিন্তু এখন ফলে ৩০ মণ পর্যন্ত। উচ্চফলনশীল জাতের ধান উদ্ভাবন, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, সার-কীটনাশকের সহজলভ্যতা ইত্যাদির ফলে ধান উৎপাদনে এই ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বনির্ভর দেশ—এই কথার অর্থ হলো, আমাদের প্রধান খাদ্য চাল আমরা এত পরিমাণ উৎপাদন করতে পারি যে তা দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের ভাতের চাহিদা পূরণ হয়। এমনকি কোনো কোনো বছর কিছু উদ্বৃত্তও থেকে যায়।

কাণ্ডজ্ঞান বলে, কৃষির উন্নতি হলে কৃষকেরও উন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু বড় দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে কৃষির উন্নতির তুলনায় কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। কৃষকের আয় খুব কম। কৃষকেরা নিজেদের বলেন ‘গরিব মানুষ’। বাংলাদেশে আজ আর ধনী কৃষক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘কৃষিকাজে লাভ নাই’—এই কথা উত্তরবঙ্গে গেলে খুব শুনতে পাই। কথাটার মধ্যে চাপা হাহাকার টের পাওয়া যায়। কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়ে তা বিক্রি করে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে হিমশিম খান।

কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশা তাঁদের মধ্যে, যাঁরা মূলত ধান চাষ করেন। কারণ, উৎপাদন খরচের তুলনায় ধানের দাম সাধারণত কম হয়। ধানের ফলন খুব বেশি হলে দাম আরও কমে যায় এবং ধানচাষির লোকসান বাড়ে। চলতি বোরো মৌসুমে সেটাই ঘটেছে। ধানের বাম্পার ফলন ধানচাষিদের দুঃখ-হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এত বেশি শোরগোল হয়েছে যে সরকারের জন্য এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার এবার কৃষকদের কাছ থেকে অন্যবারের চেয়ে বেশি পরিমাণ ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, দেড় লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান কেনা হবে; কিন্তু ধানচাষিদের তীব্র ক্ষোভ-হতাশার খবর এবং সংবাদমাধ্যমে তার ব্যাপক জনপ্রতিক্রিয়া লক্ষ করে সরকার আরও আড়াই লাখ টন ধান কেনা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে খাদ্যমন্ত্রীর বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বাড়তি আড়াই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর। অর্থাৎ ধানচাষিদের ক্ষোভের বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গুরুত্ব পেয়েছে।

কিন্তু সরাসরি ধানচাষির কাছ থেকে সরকারের ধান কেনা কর্মসূচি বাস্তবে যেভাবে চলছে, তাতে ধানচাষির দুঃখ-হতাশা-ক্ষোভ দূর হওয়ার নয় এবং তা হচ্ছেও না। কারণ, প্রথমত এই কর্মসূচিতে কিছু মৌলিক ত্রুটি বা অসংগতি আছে, আছে অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি ও নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রভাব, যার ফলে প্রকৃত ধানচাষিদের বৃহত্তর অংশই সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে সরাসরি সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারছে না। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিকে উত্তরবঙ্গের জয়পুরহাট জেলায় বেড়াতে গিয়ে ধানচাষি, চাতালমালিক, জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে সরকারের ধান কেনা কর্মসূচি সম্পর্কে আমার যে ধারণা হলো, তাতে এটাকে ‘সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা কর্মসূচি’ বলা যায় না। এই কর্মসূচির প্রথম অসংগতি হলো, সরকারের পক্ষ থেকে ক্রয়যোগ্য ধানের আর্দ্রতার ন্যূনতম মাত্রা (১৪ শতাংশ) বেঁধে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু খতিয়ে দেখা হয়নি এই গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে ধানচাষিদের ধান অতটা ভালোভাবে শুকানোর ব্যবস্থা আছে কি না। ধানচাষিরা ধান শুকান মাটির উঠানে; গ্রীষ্ম-বর্ষা মৌসুমে, যখন বোরো ধান কাটা হয়, তখন উঠানের মাটিতে আর্দ্রতা থাকে। সেই উঠানে ধান শুকিয়ে তার আর্দ্রতা কমিয়ে ১৪ শতাংশে নামানো যায় না। জয়পুরহাট জেলায় অনেক ধানচাষির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে; প্রত্যেকেই একই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। কেউ কেউ বাজি ধরে বলেছেন, কোনো চাষি যদি মাটির উঠানে কাঁচা ধান শুকিয়ে ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশে নামাতে পারেন, তাহলে তিনি তাঁর ‘গোলামি’ করবেন। তাঁরা আমাকে বলেন, ধান শুকিয়ে আর্দ্রতা ১৪ শতাংশে নামাতে পারেন চাতালের মালিকেরা, কারণ ধান শুকানোর জন্য তাঁদের পাকা জায়গা আছে। সংক্ষেপে ধানচাষিদের বক্তব্য হলো, বোরো মৌসুমে ধানের ন্যূনতম আর্দ্রতা ১৪ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়ে সরকারের ধান কেনার কর্মসূচি কার্যত সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার কর্মসূচি নয়, এটা কার্যত চাতালের মালিকদের কাছ থেকে ধান কেনার কর্মসূচি। কারণ, শুধু তাঁরাই ধান সেইভাবে শুকাতে পারেন।

সরকারের ধান কেনা কর্মসূচির এই মৌলিক অসংগতির কারণে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হতে পারছে না। ধানের ন্যূনতম আর্দ্রতার শর্তের সুযোগে খাদ্যনিয়ন্ত্রকদের কার্যালয়গুলোতে ধান কেনার সময় অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধেও সেই দুর্নীতিতে অংশগ্রহণের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের টাকাপয়সা দিয়ে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করা যায়—এমন কথা আমি জয়পুরহাট-কালাই এলাকায় একাধিক মানুষের মুখে শুনেছি। আরও শুনেছি, যেসব ধানচাষি সরকারি দলের সমর্থক, তাঁদের ধান আর্দ্রতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খাদ্য কর্মকর্তার অফিসে বিক্রি হতে পারে।

সামগ্রিক বিচারে ‘সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে’ সরকারের ধান কেনা কর্মসূচি চলমান রূপে একটি অসফল ও হতাশাব্যঞ্জক কর্মসূচি, যা ধানচাষিদের স্থায়ী ক্ষোভের অন্যতম কারণ। এটাকে সফল করতে হলে প্রথমেই ধানের ন্যূনতম আর্দ্রতার শর্তটি তুলে দিতে হবে। সরকার যদি বোরো মৌসুমে সরাসরি ধানচাষিদের কাছ থেকেই ধান কিনতে চায়, তাহলে কাঁচা ধানই কিনতে হবে, অন্যথায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন অসম্ভব। এই শর্ত তুলে নিলে অনিয়ম-দুর্নীতি ও সেই উদ্দেশ্যে ধানচাষিদের হয়রানি করার সুযোগ অনেকাংশে কমে যাবে। তবে দুর্নীতি যেহেতু অংশত মজ্জাগত ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, তাই খাদ্যনিয়ন্ত্রকের কার্যালয়গুলোর অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করতে হবে; ধানচাষিদের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

তবু আরও কথা থেকে যাচ্ছে। অতি শুভবাদী মনে হলেও ধরা যাক, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার সরকারি কর্মসূচির সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা গেল, ধানচাষিরা সরকার-নির্ধারিত দামে সরকারের কাছেই ধান বিক্রি করতে পারছেন। তারপরেও কি তাঁদের দুঃখ ঘুচবে?

আমার সংশয়, সেটা সম্ভব হবে না। সরকার মোট চার লাখ টন ধান কিনলে তার প্রভাবে বাজারে ধানের দাম বাড়বে এবং ধানচাষি তথাকথিত ‘ন্যায্যমূল্য’ পাবেন—এমন আশা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, মোট উৎপাদিত ধানের (চলতি বোরো মৌসুমে প্রায় ২ কোটি মেট্রিক টন) তুলনায় সরকারের কেনা ধানের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জয়পুরহাট জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে এক খাদ্য পরিদর্শক আমাকে বলেন, জয়পুরহাট জেলায় মোট প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপন্ন হয়েছে; এর মধ্যে সরকারের কেনার বরাদ্দ মাত্র ৪৫০ মেট্রিক টন। বাকি সাড়ে ৮৯ হাজার মেট্রিক টন ধান কিনবে কে? চাতাল ও চালকলের মালিকেরা ছাড়া এই ধানের আর কোনো ক্রেতা নেই। অর্থাৎ, নিন্দার্থে যাঁদের মধ্যস্বত্বভোগী বলা হয়, সেই চাতাল ও চালকলের মালিকদের কাছে ধান বিক্রি করা ছাড়া ধানচাষিদের কোনো উপায় থাকে না এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে তাঁদের ধানের দামও নির্ধারিত হয় চাহিদা-সরবরাহের সমীকরণে। মোট উৎপাদিত ধানের মাত্র ১ শতাংশ সরকার কৃষকদের কাছ থেকে কিনলে ধানের বাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব আশা করা যায় না। তা ছাড়া, সরকারের পক্ষে বছরে মোট ১৫ লাখ টনের বেশি ধান কেনা সম্ভব নয়, কারণ, সব সরকারি গুদামের মোট খাদ্যশস্য ধারণের ক্ষমতা প্রায় ২০ লাখ টন। সেগুলোতে ধান ছাড়াও চাল আর গমও মজুত রাখতে হয়।

তাহলে ধানচাষির দুঃখ দূর করা যাবে কীভাবে?

সরকারকে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যার ফলে ধানের উৎপাদন খরচ বর্তমানের তুলনায় অন্তত অর্ধেক কমে যাবে। উৎপাদন খরচ কমানো ছাড়া ধানচাষিকে লোকসানের চক্র থেকে বের করে আনার কোনো বাস্তবসম্মত উপায় আছে বলে মনে হচ্ছে না।

মশিউল আলম: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]