আমি কেন জেলে ছিলাম

শিমুল বিশ্বাস
শিমুল বিশ্বাস

শৈশবে একটি গল্পে পড়েছিলাম, একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে শূলে চড়ানোর আগে রাজা লক্ষ করলেন, লোকটি খুবই দুর্বল ও শীর্ণকায়। এমন দুর্বল মানুষের মৃত্যুদণ্ড দেখে রাজা তৃপ্তি পাবেন না বলে একজন স্বাস্থ্যবান লোককে ধরে এনে রাজার মনোরঞ্জনের জন্য তাকে শূলে চড়ানো হয়েছিল।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমাকে বেশ কয়েকবার জেলে যেতে হয়েছে। জেল আমার কাছে পাঠশালার মতো। যখনই আমি জেলে গিয়েছি, নতুন কিছু ভাবার সুযোগ পেয়েছি, পড়ার সুযোগ পেয়েছি, শেখার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু দীর্ঘদিনের মাঠের রাজনৈতিক জীবন পেরিয়ে এসে ২০১৩ সালে এবং ২০১৮ সালে আমি কেন জেলে গিয়েছিলাম, সেটা পর্যালোচনা করতে বসলে কেবল শৈশবের ওই গল্পটির কথাই মনে পড়ে। 

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ২০০৭ সালে আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপির চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী হিসেবে যোগদান করি। এই পদে বসে মাঠের রাজনীতি করার অবকাশ ছিল না, সরাসরি মিটিং–মিছিলে যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। যেহেতু আমি মাঠে–ময়দানে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম না এবং বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাজ করতাম, সেই কারণে আমার ধারণা ছিল, সরকারের পক্ষ থেকে আর যা–ই হোক, বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে শেষ সময়ের যোগাযোগ বা আলোচনার পথ খোলা রাখার স্বার্থে হলেও আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। কিন্তু আমার সেই পুঁথিগত ধারণা ভুল ছিল। ২০১৩ সালের ৮ নভেম্বর মধ্যরাতে বেগম খালেদা জিয়ার অফিস থেকে ফেরার পথে আমাকে ও আবদুল আউয়াল মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়; পরে একই রাতে মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া, এম কে আনোয়ারকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং নাশকতার মামলায় আটক দেখিয়ে প্রায় চার মাস আমাকে জেলে রাখা হয়।

এরপর থেকে আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলা করা হয়েছে। এর যেকোনো একটি মামলাতেই আমাকে যাবজ্জীবন সাজা বা ফাঁসি দেওয়া সম্ভব। অথচ মামলায় বর্ণিত নাশকতা, বোমাবাজি ইত্যাদি ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হওয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। 

এই মামলাগুলো মাথায় নিয়েই আমি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করে গেছি। ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণার পর ম্যাডামকে জেলে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ডিবি পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের নামে টানা ১৯ দিন আমাকে ডিবি কার্যালয়ে আটক রাখা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের নামে এই আটক রাখার প্রতিকার চেয়ে আমার পরিবার হাইকোর্টে রিট পিটিশন মামলা দায়ের করলে উচ্চ আদালত রিমান্ড বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অমান্য করায় পুলিশের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। রুল জারির পর পুলিশ ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১১০টি গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আমাকে কারাগারে পাঠায়।

আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা ঢাকা মহানগর আদালতের আওতাধীন হওয়া সত্ত্বেও শুধু নির্জন কারাবাসে থাকতে বাধ্য করার জন্য আমাকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নারায়ণগঞ্জ কারাগারের স্যাঁতসেঁতে এক কক্ষে সম্পূর্ণ একাকী বন্দী রাখা হয়। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো মামলায় হাজিরার নামে নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে ঢাকায় বিভিন্ন আদালতে আমাকে আনা-নেওয়া করা হতো। শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দীর যাতায়াত সুবিধা প্রাপ্য হওয়ার পরেও আমাকে আনা-নেওয়া করা হতো প্রিজন ভ্যানে। 

আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১০টি গায়েবি মামলায় জামিন চেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও জজকোর্টে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে পৃথক পৃথকভাবে আবেদন করা হয়। এসব মামলায় আমার সহ–আসামিরা জামিনে ছিলেন। তা ছাড়া মামলাগুলোর এজাহার বা চার্জশিটে আমার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু তারপরেও নিম্ন আদালত একটি মামলায়ও আমাকে জামিন দেননি। উপরন্তু ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট এবং জজকোর্ট জামিনের আবেদন শুনানি ও নকল দিতে অস্বাভাবিক সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। বাধ্য হয়ে আমাদের আইনজীবীরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। উচ্চ আদালত পুলিশের দায়েরকৃত গায়েবি মামলায় নানা ত্রুটি উল্লেখ করে বেশ কিছু মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন এবং পর্যায়ক্রমে সব মামলায় জামিন মঞ্জুর করেন।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত সব মামলায় জামিন দিলেও কারাগার থেকে মুক্তি পেতে আমাকে আরও প্রায় পৌনে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। উচ্চ আদালতে সর্বশেষ মামলায় জামিন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যেনতেন একটি বিচারাধীন মামলায় নতুনভাবে আটক দেখিয়ে নিম্ন আদালত কর্তৃক ওয়ারেন্ট ইস্যু করিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সেই বিচারাধীন মামলায়ও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও জজকোর্ট জামিন দেননি। হাইকোর্ট সে মামলায়ও জামিন দেওয়ার পর পুলিশ একই প্রক্রিয়ায় নতুন নতুন পেন্ডিং মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে থাকে। 

এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের পক্ষ থেকে আবারও রিট পিটিশন দায়ের করলে উচ্চ আদালত নতুন কোনো বিচারাধীন মামলায় আমাকে পুনঃ গ্রেপ্তার না করার জন্য সুনির্দিষ্ট আদেশ দেন। তারপরও পুলিশ অভিনব এক অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। যেমন নতুনভাবে আবার বিচারাধীন মামলা,
যে মামলার এজাহারে আমার নামগন্ধ কিছুই নেই, তেমনি মামলার চার্জশিটে ভৌতিক কায়দায় আমার নাম ঢুকিয়ে পুলিশ নিম্ন আদালতের সহায়তায় পি/ডব্লিউ, সি/ডব্লিউ ইস্যু করিয়ে কারাগারে আটক রাখার আদেশ পাঠিয়ে দেয়। ৯ মাস যাবৎ এমন নিবর্তনমূলক প্রক্রিয়ায় কারাগার থেকে আমার মুক্তি আটকে রাখা হয়। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, আমাকে গ্রেপ্তার করার পরে আমি যখন ডিবি অফিসে আটক ছিলাম এবং কারাগারে ছিলাম, সেই সময়ের দায়েরকৃত গায়েবি মামলাতেও আমাকে আটক দেখানো হয়েছে। এমন অভিনব প্রক্রিয়া চলতে থাকায় আমার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১১৯টিতে দাঁড়িয়েছে।

কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লেও চিকিৎসার মতো মানবিক ও মৌলিক সহায়তা পেতে আমাকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত রিট পিটিশন মামলা করেই চিকিৎসাসুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। উচ্চ আদালত বিশেষায়িত হাসপাতালে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলে কারা কর্তৃপক্ষ বিএসএমএমইউতে আমাকে ভর্তি করে। কিন্তু মাত্র ৬ দিনের মাথায় এক অজ্ঞাত নির্দেশের কথা বলে দায়িত্বরত চিকিৎসকদের মতামত অগ্রাহ্য করে অসুস্থ অবস্থায় আমাকে আবারও কারাগারে ফেরত নেওয়া হয়। 

গত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ আমি হঠাৎ করে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরিস্থিতি সামাল দিতে জেল কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় চিকিৎসকদের আমাকে দেখাতে নিয়ে আসেন। চিকিৎসকেরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দিয়ে চলে যান। কিন্তু সেই সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা অসমাপ্ত রেখেই এই অসুস্থ অবস্থাতেও ২৬ ফেব্রুয়ারি জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে অমানবিকভাবে আদালতে নিয়ে যায়। আদালত থেকে ফেরার পথে মনে হচ্ছিল আমি বোধ হয় মারা যাচ্ছি, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। নারায়ণগঞ্জ স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ৫ মার্চ পুনরায় আমার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা–পর্যালোচনা করে আমাকে বিএসএমএমইউতে ভর্তির জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু বিস্মিত হয়ে দেখলাম, আমাকে হাসপাতালে ভর্তি না করে ৭ মার্চ ভোরবেলা নারায়ণগঞ্জ কারাগার থেকে আরও দূরে নরসিংদী জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হলো। 

আমি হলফ করে লিখছি, আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একটি মামলার ঘটনা সত্যি নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। হয়তো গল্পের ওই রাজার মতোই বিশেষ কারও অভিলাষ বা মনস্কামনা পূরণের জন্যই আমাকে এভাবে ৪৫১ দিন মিথ্যা মামলায় কারাগারে কষ্ট করতে হলো।

আমি না হয় সরকারি উচ্চ পদে চাকরি করার কারণে শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দী ছিলাম এবং পারিবারিক সহায়তার কারণে বারবার হাইকোর্ট থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসে নিজের এই দুরবস্থার অবসান ঘটাতে পেরেছি। কিন্তু এমন হাজার হাজার ভুয়া মামলায় দেশের লাখ লাখ বিরোধীদলীয় নেতা–কর্মী অমানবিক কষ্ট ভোগ করছেন, তার দায় কি কেবলই ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের? দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কি কোনো দায় নেই? তাঁরা কি সরকার বা সরকারি দলের কর্মচারী, নাকি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী? এর পরিণতি কী হবে, সেটা কি তাঁরা একবার ভেবে দেখেছেন?

শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী