উত্তরবঙ্গ: নদী কেটে খাল

নদী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় একটি কথা শুনেছি—নদী কেটে খাল করা হয়েছে। কথাটি শুনতে কিছুটা উল্টো শোনায়। তবে ঘটনা সত্য। কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার ওপর দিয়ে একসময় প্রবাহিত হতো দেউল নদ। প্রস্থ আর গভীরতা বিচারে স্থানীয়ভাবে এটাকে দেউল সাগরও বলা হতো। এখন নদটির দিকে তাকালে মনে হবে একটি খাল। একইভাবে রংপুরের আখিরা, সোনামতী, ভেলুয়া নদীর দিকে তাকালে এগুলোকে খাল ছাড়া অন্য কিছু বলা কঠিন। কিন্তু স্থানীয় বয়স্কজনদের কাছে এগুলোর বিশাল রূপের কথা জানা যায়। নদীগুলো খালের আকৃতি ধারণ করার কারণ, যখন নদীগুলো স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হয়, তখন এগুলোর উঁচু কোনো পাড় থাকে না। সমতলভূমির চেয়ে গভীর হয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু যখন খনন করা হয়, তখন মাটি তুলে নদীর দুপাশে উঁচু করে ফেলা হয়। নদীর দুই পাশ উঁচু আর মধ্যবর্তী অংশটুকু গভীর হয়। তখন দেখতে খাল মনে হয়। 

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তাপারের এক কৃষক কয়েক দিন আগে বিদ্রূপ করে বলছিলেন, ‘সরকারের টাকা বেশি হইছে তো, সেই জন্যে টাকা পানিত ভাসে দেয়। তা না হইলে কাঁইয়ো নদীর মাঝখানোত খাল কাটে?’ রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বুরাইল নদের পারে স্থানীয় এক বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘একটা বড় নদী কাটি তিনটা খাইল (খাল) বানাইছে।’ রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্মশানের পাশে চিকলী নদীর পারের স্থায়ী বাসিন্দা রমাকান্ত রায় বলছিলেন, ‘যেমন করি নদী কাটতেছে, তাতে নদীর কোনো উপকার হবার নয়।’ চিকলীর মতো বিশাল নদীও খননের নামে ধ্বংসের মুখে পড়েছে। 

 পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের মাধ্যমে রংপুরের তিস্তা, বুরাইল, মানাস, চিকলী, খোকসা ঘাঘট, মরা, খটখটিয়া নদী খনন করা হচ্ছে। আমি এই খননকাজ দেখে এসেছি। যেভাবে এসব নদী খনন করা হচ্ছে, তাতে নদী খনন না বলে বরং নদীকে খাল বানানোর প্রকল্প বলা যেতে পারে। উল্লিখিত নদীগুলোর একটিও বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করা হচ্ছে না। তিস্তা নদী যে স্থানে প্রস্থে প্রায় ১০ কিলোমিটার, সেখানে খনন করা হচ্ছে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ফুট। সেই বালু ফেলা হচ্ছে খনন করা খালের দুপাশে। এই খনন যে শতভাগ জলেই যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

বুরাইল নদ যেখানে ২৫০ ফুট প্রস্থ, সেখানে খনন করা হচ্ছে মাত্র ৪০ ফুট। নদের পারেই ঠিকাদার মকবুল হোসেনের দেখা হয়েছিল। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা যেটুকু কাটার নির্দেশ পেয়েছি, সেটুকুই কাটছি।’ হারাগাছ পৌরসভায় তালেব মিয়ার টারিতে মানাস নদের সেতুর যে প্রস্থ, খনন করা হচ্ছে তার প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। চিকলী নদী যেখানে ৫০০ ফুট প্রস্থ, সেখানে খনন করা হচ্ছে মাত্র ১০০ ফুট। একইভাবে অন্য নদীগুলোও খনন করা হচ্ছে। যে নদীগুলোর কথা আমি বললাম, তার একটিরও বালু নদীর পারে কিংবা নদীর বাইরে ফেলা হয়নি। খননকৃত বালু-মাটিগুলো ফেলা হয়েছে নদীর ভেতরেই খনন করা অংশের দুপাশে। খননকৃত অংশের দুপাশে যে দুটি অংশে নদী থাকল, সেগুলো ভবিষ্যতে দখলদারেরা সহজেই দখল করতে পারবে। খনন করার মাধ্যমে নদীর পানি ধারণক্ষমতা কোথাও কোথাও কমছে। 

রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া একটি নদীর নাম ‘মরা’। এ নদীকেও খালে পরিণত করা হচ্ছে। কিছুদিন আগে খবর নিতে গিয়েছিলাম পীরগঞ্জ উপজেলায়। প্রথমে কাশীপুর গ্রামে যাই। স্থানীয় কাশেম মাস্টারের মেয়ে জানালেন, ২৫ থেকে ৩০ বছর আগে, ছোটবেলায় এ নদীতে তিনি নৌকাবাইচ দেখেছেন। এ নদীর ওপর সেতু হওয়ার আগে নৌকাযোগে পার হতে হতো। নদী তখন অনেক বড় ছিল। এখনো নদীর পারে দাঁড়ালে
নদীর বিশাল প্রস্থ চোখে পড়ে। ওই স্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলতেই গাইবান্ধা সরকারি মহিলা কলেজের প্রভাষক তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বলছিলেন, ‘নদী হচ্ছে দেশের প্রাণ। সেই নদীকে ধ্বংস করলে দেশের কি প্রাণ থাকে?’ 

সরকার নদী খনন করার জন্য এ বছর একটি বড় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু যাঁরা প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, তাঁরা নদী রক্ষার জন্য কতখানি বাস্তবসম্মত প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। রংপুরের বাস্তবতা শুধু এ রকম তা নয়। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় লাচ্ছি নদের খনন ঠিকমতো হচ্ছে না মর্মে প্রথম আলোয় খবর প্রকাশিত হয়েছে। কুড়িগ্রামের বুড়িতিস্তারও একই অবস্থা। সিএস নকশা এবং বর্তমানে নদীর অবস্থান—দুইয়ে মিলে নদী খনন করতে হবে। তা না হলে হাজার হাজার কোটি টাকায় নদী খনন কোনো কাজে আসবে না। 

বাংলাদেশে নদী খননের জন্য বর্ষা মৌসুম বেছে নেওয়া হচ্ছে। বর্ষায় কাজ করলে ঠিকাদারেরা ইচ্ছেমতো খননের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন বলেই খননকাজ বর্ষা মৌসুমে করা হয় কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নদী খননের সঙ্গে অসাধু চক্র থাকলে নদীর টাকা অসাধুরাই লুটেপুটে খাবে। নদী খননের নামে নদীর সর্বনাশ বন্ধ করতে সরকার অনতিবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক