গণতন্ত্রের জয়ের পথ দেখাচ্ছে ইস্তাম্বুল

ইস্তাম্বুলে একেপির হারের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। ছবি: রয়টার্স
ইস্তাম্বুলে একেপির হারের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। ছবি: রয়টার্স

প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে থাকা হাই ইলেকশন কাউন্সিল গত ৬ মে যখন ইস্তাম্বুলের সব গুরুত্বপূর্ণ মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন বাতিল করেছিল, তখন সবাই যৌক্তিকভাবেই উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু এখন নতুন করে অনুষ্ঠিত ইস্তাম্বুল মিউনিসিপ্যালের ভোটের পর যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানেরই উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা। 

এ বছরের ৩১ মার্চ তুরস্কের স্থানীয় নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনকে এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে-বিপক্ষের গণভোট হিসেবে দেখা হচ্ছিল। আপত্তির মুখে ইস্তাম্বুলে পুনরায় ভোট নেওয়া হয়। এরপরই পূর্ণাঙ্গ ফলাফল পাওয়া গেল। ফলাফলে দেখা গেছে, বিরোধীদলীয় রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মহানগর এলাকা আঙ্কারা, ইজমির ও ইস্তাম্বুলে জয়ী হয়েছে। দেশটির অর্থনৈতিক রাজধানী ও সবচেয়ে জনবহুল শহর ইস্তাম্বুলের বিজয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এর প্রতীকী গুরুত্বের বাইরেও এই শহরের ক্ষমতা দখলের ক্ষমতা বিরোধীদের হাতে যাওয়ার বিষয়টিও তাৎপর্যপূর্ণ। ইস্তাম্বুলের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা খোদ এরদোয়ানের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘ইস্তাম্বুল জয় করা মানে তুরস্ককে জয় করা।’ 

ফিলিপাইন, ব্রাজিল, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশের জনতুষ্টিবাদী নেতাদের মতো প্রথমদিকে এরদোয়ানও একজন মেয়র ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন। ইস্তাম্বুল ভোটে অনিয়মের অভিযোগে প্রথমদিকে সবাই ভোট বয়কট করলেও পরে সিএইচপি নির্বাচন করতে রাজি হয়। ২০০২ সাল থেকে এরদোয়ানের একেপি পার্টি তুরস্কের ক্ষমতায় এবং ১৯৯৪ সাল থেকে তারাই ইস্তাম্বুলের মেয়রের পদ দখল করে রেখেছিল। এবার তাদেরই সিএইচপি হারিয়ে দিল। সিএইচপির প্রার্থী একরেম ইমামোগলু ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে একেপির প্রার্থী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদ্রিমকে হারিয়ে নতুন মেয়র হয়েছেন। 

ইস্তাম্বুলে একেপির এই হারের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর, কারণ এর মাধ্যমে কর্তৃত্বপরায়ণ জনতুষ্টিবাদীদের মূল দুর্বলতা সামনে চলে এসেছে। সেই দুর্বলতার নাম ‘ব্যালট বাক্স’। আজকের দিনের জনতুষ্টিবাদীরা আগের দিনের লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া কিংবা তুরস্কের একনায়কদের মতো নয়। আগের দিনের সেই নেতারা উর্দি পরে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে গদিতে চেপে বসতেন। চিলির অগাস্তো পিনোশের মতো গণতন্ত্রের শত্রুরা সহিংসতার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করতেন এবং যাঁরাই তাঁদের বিরোধিতা করতেন, তাঁদের খুন, নির্যাতন ও কারাবন্দী করে সব ধরনের বিরুদ্ধ স্রোতকে দমন করে রাখতেন। 

কিন্তু গত দুই দশকে দেখা গেছে, জনতুষ্টিবাদীরা নির্বাচনের পিঠে সওয়ার হয়ে ক্ষমতায় আসছেন এবং দৃষ্টিগ্রাহ্য পন্থায় বিরোধীদের খুন করছেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভেদকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করছেন এবং ক্ষমতায় বসার পরই দানব হয়ে উঠছেন। ক্ষমতায় বসেই তাঁরা বিরোধীদের ওপর দমনপীড়ন শুরু করেন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ সময়ও তাঁরা জনসমর্থন হারাতে চান না। সংখ্যাগুরুর সমর্থন পেতে তাঁরা বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণের মধ্যে বিভক্তি টেনে রাখেন। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এই বিভক্তি চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় এবং সরকারের গুণগান করার জন্য তখন সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর চাপ বাড়ানো হয়। 

অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত, অপেক্ষাকৃত বেশি ধার্মিক এবং অপেক্ষাকৃত কম পশ্চিমা জীবনযাপনকারী তুর্কিরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের প্রান্তিক ও কোণঠাসা মনে করে এসেছে। তারা একধরনের হতাশায় নিমজ্জিত ছিল। এই শ্রেণির সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের হতাশাকে কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান ইসলামি জাতীয়তাবাদের ডাক দিয়েছিলেন। সেই ডাকে তারা দলে দলে এরদোয়ানকে সমর্থন করেছে। ১৭ বছর ধরে এরদোয়ান ‘জনগণের’ মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন এবং একের পর এক নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। কিন্তু এর মধ্যে তিনি ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে উঠেছেন। একপর্যায়ে দেখে গেছে, তুরস্কের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন স্টেশনগুলো আর স্বাধীন নেই এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এরদোয়ানের অনুগত ব্যক্তিরা দখল করে ফেলেছেন। 

তবে ইস্তাম্বুলের এই ফলাফলে এরদোয়ানের আসল দুর্বলতা বেরিয়ে পড়েছে। ব্যালটে যাঁর জয় হয়েছিল, ব্যালটেই তাঁর পরাজয় হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে, জনগণের মোহ কেটেছে এবং জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসান ঘটিয়ে মানুষ এখন আবার গণতন্ত্রের দিকেই যেতে চাইছে। 

এটি ঠিক যে ইস্তাম্বুলের এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তুরস্কে এখনই একেপির শাসনের অবসান হচ্ছে না। কিন্তু এই ফল তুরস্কের গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ—এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
দারোন আসেমোগলু এমআইটির অর্থনীতির অধ্যাপক
জেমস এ রবিনসন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল কনফ্লিক্ট বিষয়ের অধ্যাপক