নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কী বিচার চাইব

বরগুনায় রিফাত শরীফ নামের এক তরুণকে তাঁর স্ত্রীর সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, সেই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই ঘটনা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম আলো অনলাইন শিরোনাম করেছে: ‘এভাবে প্রকাশ্যে কোপাল!’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের সরবতার নানা মাত্রা, নানা কোণ। একদল মুষড়ে পড়েছে, ভীষণ আঘাত পেয়ে স্তম্ভিত হয়েছে ঘটনার নৃশংসতার মাত্রার কারণে। কেউ কেউ বলছেন, হবেই তো এ রকম। কারণ, কতগুলো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। কেউবা পাড়ছেন বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচারের সাজা আপিলে হ্রাস করার উদাহরণ।

মানুষের তীব্র প্রতিক্রিয়ার একটা উপলক্ষ রিফাত হত্যাকাণ্ডের মুহূর্তের ছবি, যাতে দেখা যাচ্ছে হন্তারকেরা অস্ত্র চালাচ্ছে, রিফাতের স্ত্রী বাধা দিচ্ছেন আর অনেক মানুষ, খুব কাছেই তারা, নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের মানুষ একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসে, এই ক্ষেত্রে কেউ বাধা দিল না কেন? কারও কারও প্রশ্ন, ভিডিও না করে হন্তারকদের বাধা দিলে কি একটা প্রাণ বাঁচানো যেত না!

অধ্যাপক আলী রীয়াজ তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন: ‘বরগুনায় রিফাতকে যখন কুপিয়ে হত্যা করা হয়, তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা যখন একাই হন্তারকদের মোকাবিলা করেছেন, কেউ এগিয়ে আসেনি; “ভয়ের সংস্কৃতি সম্মিলিত উদ্যোগের ধারণা লুপ্ত করে দেয়। এই প্রক্রিয়ার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মানুষকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে রূপান্তরিত করা হয়। আতঙ্ক এবং সন্ত্রাস মানুষের প্রতিরোধের শক্তি চূর্ণ করে দেয়”’ (ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, আলী রীয়াজ, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪)।

আলী রীয়াজের তাঁর নিজের বই থেকে দেওয়া উদ্ধৃতিটা একটু সাধারণীকৃত; একটা পর্যবেক্ষণ, একটা উপলব্ধি অনেকটা মন্তব্যের মতো হলেও এর পেছনে ভাবনার খোরাক আছে। বিষয়টা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা যায়, গভীর গবেষণা করা যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমরা নাগরিকেরা ভয়ের মধ্যে আছি, একদা কল্পিত ইথারের মতোই আমরা ভয়ের সমুদ্রে ডুবে আছি। আমরা কথা বলার আগে দুবার ভাবি, রাস্তায় পথ হাঁটার সময় পেছনে দুবার তাকাই। কিন্তু তাই বলে নাগরিকেরা সর্বত্র এই ভয়ের সংস্কৃতির কারণে নির্লিপ্ত, নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, এভাবে ভাবাটা মানুষের সমাজকে রক্তকরবীর মতো একটা যক্ষপুরী কিংবা সমস্ত সমাজকে একটা যন্ত্র আর প্রত্যেক মানুষকে তার একটা নাট বা বল্টু ভাবার মতো অতিসরল বলে মনে হয়। রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত।...কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে—জীবনযাত্রার জন্য যত-কিছু সুযোগ সুবিধে সব-কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত।’ কিন্তু আমাদের দেশে এই মানুষেরা অন্যের বিপদে এগিয়ে যায়। এরাই পড়শির বাড়ির আগুন নেভাতে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়, রানা প্লাজার সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়ে মানুষ বাঁচানোর চেষ্টায় নিজের জীবনকে বিপন্ন করে, বনানীর আগুনে পোড়া ভবনে উঠে মানুষকে উদ্ধারে ব্রতী হয়। ভদ্রলোকেরা সাধারণত অন্যের বিপদে নিজের প্রাইভেসির আড়াল খোঁজে। নিরাপদ তন্দ্রায় তারা আচ্ছন্ন কিংবা চিলেকোঠার সেপাই তারা। বরগুনার ওই নৃশংস ঘটনার সময় মানুষ বাধা দিল না কেন, ধাওয়া দিল না কেন—এই প্রশ্ন সংগত। এর রেডিমেড উত্তর আমাদের কাছে নেই। আলী রীয়াজের প্রস্তাবটা আমাদের বিবেচনায় নিতেই হচ্ছে।

এরপর যে কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দেখতে পাচ্ছি, আমার ফেসবুক-বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, গ্রেপ্তার হওয়া যুবককে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন অস্ত্র উদ্ধারে বেরোচ্ছে না? ইঙ্গিত খুবই স্পষ্ট। কারণ, সেই পুরোনো প্রেসনোট; গ্রেপ্তারকৃত সন্ত্রাসীদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে বের হওয়ার পর আগে থেকে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা হামলা করে, তখন এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ার হয়; গ্রেপ্তারকৃতরা মারা পড়ে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের অনেকেই ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারকে সমর্থন করছেন।

এটাও সার্বিকভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই তুলে ধরে। আমাদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, প্রকৃত অপরাধীদের সাজা না হওয়ার উদাহরণগুলো থেকেই মানুষ এই শর্টকাটের কথা ভাবতে পারছে।

আমাদের বন্ধু সাংবাদিক অঞ্জন রায় তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন:
‘কিন্তু আলোচিত কোনো হত্যার ঘটনায় ক্রসফায়ারের দাবিটি আমার কাছে মধ্যযুগীয়। কারণ আমি যখন একজনকে ক্রসফায়ারে বা এনকাউন্টারে দেয়ার দাবি তুলব—তখন আমি নৈতিকভাবে মেনেই নেব, আমার এই বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা নাই। সমাজের বিশিষ্টজনেরা যখন যত ঘৃণ্য অপরাধই হোক—তার জন্য বিচারের বদলে অপরাধীকে কয়েকটি বুলেট খরচ করে মেরে ফেলার দাবি করেন, তা–ও সেই দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে—তখন শঙ্কা তৈরি হয়। ভয় হয় আমরা কি সত্যিই সোশ্যাল মিডিয়া হাতে পেয়ে গণ–হিস্টিরিয়ার রোগী হয়ে উঠছি? নাকি এটাই আমাদের অধিকাংশের মনোজগৎ?’

এটা যদি আমাদের অধিকাংশের মনের কথা হয়ে থাকে, তাহলে তা আরও বেশি দুশ্চিন্তার কথা। আমাদের শাসনব্যবস্থা এই ভয়াবহ বাস্তবতা তৈরি করেছে। একটা সহজ কথা আমি বুঝতে পারি না, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার যদি প্রচলিত বিচারব্যবস্থাতে দীর্ঘদিন ধরে হতে পারে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যদি ট্রাইব্যুনাল করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগসমেত প্রকাশ্যে দীর্ঘদিন ধরে হতে পারে, তাহলে আলোচিত অপরাধগুলোর বিচার কেন প্রকাশ্যে আইনানুগ পদ্ধতিতে হবে না! জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনায়েড। জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড। তবে প্রচলিত আইনে, দরকার হলে বিশেষ আইন করে বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। সেই শাস্তি নিশ্চয়ই দৃষ্টান্তমূলকও হবে। তবে রবীন্দ্রনাথের ওই কথাও মনে রাখতে বলি, ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে/সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তরে প্রাণ/কোনো ব্যথা নাহি পায় তার দণ্ডদান প্রবলের অত্যাচার।’

নিউইয়র্কে একজন বাঙালি ব্যবসায়ী জাকির খান হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় হয়েছে সম্প্রতি। তাঁর বাড়িওয়ালা তাহার মাহরান ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছুরি মেরে হত্যা করেছিলেন জাকির খানকে। বিচারের রায়ে মাহরানের ১০ বছরের জেল আর ৫ বছরের প্রবেশনকালের সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। জাকিরের স্ত্রী রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়নি বলেই আমেরিকায় খুনিরা উৎসাহিত হয়ে পড়বে বলে মনে হয় না।

আমাদের সমাজের কোনো গভীর গভীরতর অসুখ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আছে বিচারহীনতা। এর মধ্যে আছে বিচার হবে না, জনমনে এই বদ্ধমূল ধারণা। বিচার তাই হাতে তুলে নিতে হবে বা ক্রসফায়ারই হবে ঠিক বিচার, এই মনোভাব প্রবল হচ্ছে। শিক্ষিত লোকেরাও কথায় কথায় ‘রক্ত চাই’, ‘মুণ্ডু চাই’ বলে চিৎকার করে উঠছেন। এই অসুখের চিকিৎসা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। আর তা করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক বিচার, বিচারের শাস্তি কার্যকর করার মাধ্যমে। কিন্তু তাতে যেন নিষ্ঠুরতা না থাকে। নিষ্ঠুর শাস্তি কার্যকর করে আমরা যেন মধ্যযুগের মতো উল্লাস না করি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমাদের সকল সমস্যার সব চেয়ে বড়ো রাস্তা হচ্ছে শিক্ষা।’ কিন্তু যখন শিক্ষিতজনকেও দেখি বিচারের চেয়ে শাস্তির দিকে বেশি নজর, আর শাস্তিটা কী হবে, আর তা কীভাবে কার্যকর হবে, তা–ও তাঁরা বাতলে দিচ্ছেন, তখন মনে হয় এইটাই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। আমাদের শিক্ষা আমাদের মানবিক করে তুলবে না? শর্টকাট পথের বদলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কষ্টকর দীর্ঘ সংগ্রামের পথ কি আমরা বেছে নিতে পারব না?

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক