জবাই নাকি কোপ - পছন্দ কোনটা?

বরগুনা শহরের কলেজ রোডে বুধবার প্রকাশ্যে কোপানো হয় রিফাত শরীফকে। এতে তাঁর মৃত্যু হয়। ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত
বরগুনা শহরের কলেজ রোডে বুধবার প্রকাশ্যে কোপানো হয় রিফাত শরীফকে। এতে তাঁর মৃত্যু হয়। ছবি: ভিডিও থেকে সংগৃহীত

অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে। যেটাই বেছে নেবেন, দুর্গতি অবশ্যম্ভাবী। খারাপের মধ্যেই বাছাই করতে হবে। এবার সিদ্ধান্ত আপনাদের। বাছবেন কোনটি?

এমন পরিস্থিতিকে আখ্যা দিতে বাংলায় বেশ ভালো একটি প্রবাদ আছে, শাঁখের করাত। এই করাতে ধার সর্বত্র। তাই যেদিকেই যান ক্ষতবিক্ষত হতেই হবে। সেই ধার চলে আসতে পারে চাপাতি বা দা–তে। সেগুলো খড়্গ হয়ে নেমে আসতে পারে আপনার ঘাড়ে-গলায়। তবে ভাববেন না যে আপনি একা! অনেকেই আছে এদিক-সেদিক। কেউ হয়তো তাকিয়ে দেখছে অপলকে, কেউ চালু করেছে ক্যামেরা। এভাবেই আপনার মৃত্যু ইন্টারনেটে অক্ষয় রূপ ধারণ করবে। কিছুদিন হইচই হবে। ওই যা হয় আর কি! আগেও হয়েছে ঢের। একদিন সবাই আপনার নাম-পরিচয়-অবয়ব ভুলে যাবে, আপনার নিহত হওয়ার ‘আকর্ষণীয়’ ভিডিও মোবাইল থেকে মুছে যাবে। কারণ, তত দিনে চলে আসবে নতুন ভিডিও, নতুন মৃত্যু। হয়তো আগের দিন যিনি ভিডিও করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুই ধারণ হবে ক্যামেরায়।

এক বন্ধুর সৌজন্যে কিছুদিন আগে একটি শর্টফিল্ম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভারতীয় নির্মাতা গৌরব শর্মার লেখা ও পরিচালনায় ছবিটির নাম ‘দ্যাট ম্যান ইন দ্য পিকচার’। একটি অনলাইন স্ট্রিমিং ওয়েবসাইটে দেখা যায় ছবিটি। ১৮ মিনিটের এই ছবির মূল কাহিনি একজন মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষকে কেন্দ্র করে লেখা। রাস্তায় ঘটে যাওয়া একটি অপরাধ নিরাপদ দূরত্বে থেকে অবলোকন করেছিল সে। ভয় পেয়েই তাতে জড়াতে চায়নি, অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেনি। কিন্তু লোকটির নির্বিবাদে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকার সেই দৃশ্য ধরা পড়ে যায় এক সিসিটিভি ক্যামেরায়। তবে তাতে তাকে চেনা যায়নি। আর যায় কোথায়! গণমাধ্যম সেই ছবি প্রকাশ করে ‘সাধারণ’ নাগরিকের ‘নির্লিপ্ত’ আচরণের সমালোচনায় মেতে ওঠে। ওই ব্যক্তিও পুড়তে থাকে অনুশোচনায়। শেষে নিজের বিপদেও একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। শুধু আক্রান্তের জায়গায় ছিল ছবির মূল চরিত্র এবং প্রতিবাদ না করে নির্বিবাদে পালিয়ে যাওয়ার তালিকায় দেখা যায় আরেক ‘সাধারণ’ নাগরিককে!

এ দেশেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। এখানেও রাস্তাঘাটে, বিভিন্ন ভবনে নানা আকারের সিসিটিভি ক্যামেরা দেখতে পাওয়া যায়। অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা জানানোই এসব ক্যামেরার কাজ। তাতে অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। কিন্তু অপরাধের প্রতিকার কী হয়? হয় না। যদি হতো তবে ব্লগার-অ্যাকটিভিস্ট হত্যার বিচারও এত দিনে হতো। হয়নি। একজন অপরাধী যখন দেখছে, বইমেলা চলার সময় এত মানুষের মধ্যেও কাউকে কুপিয়ে জান নিকেশ করে সদর্পে বেরিয়ে যাওয়া যায়, তখন আর ভয় কীসের! তাই নির্ভীক চিত্তে চলে দা-তে শাণ দেওয়া। ঝকঝকে রোদে চকচকে ছুরি-দা নিয়ে চলে হামলা। আর তাতে কারও জীবনে পড়ে দাড়ি, আর কারও ফেসবুকে লাইক বাড়ে তাড়াতাড়ি।

বরগুনায় বুধবার সকালে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে রিফাত শরিফকে। স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। পেশাগত কারণেই এই ঘটনার ভিডিও পুরোটা দেখতে হয়েছে। সে এক যন্ত্রণা বটে! মুখ দিয়ে হয়তো বেরিয়ে পড়ে, ‘কেউ এগিয়ে এল না?’ আয়েশারও অভিযোগ, কেউ এগিয়ে আসেনি। কিন্তু এগোবে কে? এই অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক সমাজের সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতা। নির্বিবাদে জীবন কাটানোই এখন মূলমন্ত্র, তাতে কারও মাথা কাটা গেলে যাক। আমার গর্দান টিকে থাকলেই হলো, সেই বেঁচে যাওয়া মস্তিষ্কই চালাবে ছিদ্রান্বেষণ! তা না হলে যে নিজের দোষ ঢাকা দেওয়া যাবে না।

ঘটনাও যে একটি ঘটেছে, তা তো নয়। এমন অসংখ্য ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। চলতি মাসেই নরসিংদীতে ফুলন রানী বর্মণ নামের এত তরুণীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ১৩ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বুধবার সকালে তিনি মারা গেছেন। আবার বুধবার ভোরেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিউটি আক্তার নামের সংরক্ষিত নারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বিউটি সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, সেখানেই হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এসব নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ, নিষ্ঠুরতার মাপকাঠিতে মেপে সর্বোচ্চটাতেই মানুষ গুরুত্ব দিয়েছে। সুতরাং জনসাধারণের ‘মনোযোগ’ পেতে মৃত্যু হতে হবে চমক–জাগানিয়া, শিহরণযোগ্য। তবেই ভার্চ্যুয়াল জগতে ঝড় উঠবে, শুরু হবে আলোচনা।

জবাই ও কোপ নিয়ে উর্দু ভাষার বিখ্যাত গল্পকার সাদত হাসান মান্টো একটি দাঙ্গাবিষয়ক গল্প লিখেছিলেন। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত মান্টোর গল্পগ্রন্থ ‘সিয়াহ হাশিয়ে’-তে গল্পটি আছে। তাতে দেখা যায়, জবাই আর কোপ দিয়ে হত্যার বর্ণনা দিচ্ছে দুই ব্যক্তি। একজন আরেকজনকে জানাচ্ছিল ধীরে ধীরে পোঁচ দিয়ে জবাই করার ‘বীরত্ব’। তাতেই মেজাজ খিঁচড়ে যায় আরেকজনের, কারণ তার মতে—কোপ দিয়ে ধড় আলাদা করা বেশি ভালো। তাই জবাই করায় মজা পাওয়া ব্যক্তির গলা এক কোপে আলাদা করে দেয় সে।

দেশভাগের সময়কার দাঙ্গার নৃশংসতা এখনো দেখা যায়, কিছু ক্ষেত্রে আরও তীব্রভাবে। আগে নৃশংসতার কাহিনির সঙ্গে পাল্লা দিত মানবিকতার গল্পও। ভয় পেলেও কেউ না কেউ দাঁড়াত আক্রান্তের পাশে। আর এ যুগে হাত দিয়ে কোপ ঠেকানোর ব্যর্থ চেষ্টা একা করে যায় আক্রমণের শিকার ব্যক্তি। ভয়ে কুঁচকে যাওয়া আমরা আঙুল টিপি মোবাইল স্ক্রিনে, শেয়ার করি হামলার ভিডিও। এর চেয়ে বেশি কিছু করতেও আমাদের বাধা সেই ‘ভয়’, প্রতিবাদ করতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণটা না আবার খোয়াতে হয়!

আর তাই বিনয় মজুমদারের লেখা কবিতার ভাষায় বলতে গেলে, ‘...এত স্বাভাবিকভাবে সবই ব্যর্থ—ব্যর্থ, শান্ত, ধীর।’ (ফিরে এসো, চাকা)

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
[email protected]