একটা 'ভালো ক্রসফায়ার' চাই!

রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর এক ফেসবুক সেলিব্রিটি পোস্ট দিয়ে বসলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাতে রিফাতের খুনিদের ‘ক্রসফায়ারে’ দিয়ে প্রমাণ করে যে তারা ‘ভালো’ উদ্দেশ্যে ‘ক্রসফায়ার’ করে। এই ভদ্রলোক এভাবে ‘ভালো ক্রসফায়ার’-এর ধারণা ছড়ানোর চেষ্টা করলেন। রিফাতের খুনিরা খারাপ খুন করেছে, নিরীহ একজনকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে মেরেছে। তাই উচিত হবে তাদের জন্য একটা ‘ভালো ক্রসফায়ার’-এর দৃষ্টান্ত হাজির করা। এই হলো তাঁর যুক্তি। এই যুক্তির সমর্থনে অনেক মানুষই পাওয়া যাবে এ দেশে।

হত্যাও একটা নেশার মতো। কোনো নৃশংস হত্যাকাণ্ড অথবা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই একদল হই হই করে ক্রসফায়ারের দাবি তোলে। এদের ডাকেই দেশে হাজির হলো ভালো খুনের নায়ক ‘হারকিউলিস’। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, কমপক্ষে তিনজনকে হত্যা করে তাদের গলায় ‘ধর্ষক’ লেখা কাগজ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যে হাত খুন করে, এই রক্তাক্ত হাত আরও আরও খুনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন কে বলবে তাদের কোন খুনটা ভালো আর কোনটা খারাপ? তখন তাদের থামাবে কে?

‘ভালো খুনের’ দাবিতে এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকে জনপ্রিয় করেছিল বিএনপি সরকার। আজ তারা অভিযোগ তুলেছে, তারাই সবচেয়ে বেশি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার। ‘আব্বু তুমি কানতিছ’ বলে যে মেয়েটি গুলির মুখে ক্রন্দনরত পিতাকে ডেকে উঠেছিল, সেই পিতা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছিলেন। এঁদের বাইরে আরও যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নির্দলীয়। ক্রসফায়ারের তালিকায় নিরীহ সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। অথচ এসব নিরীহ মানুষের অনেকেই ‘ন্যায়বিচারে’ আস্থা হারিয়ে ক্রসফায়ারের দাবি তুলছেন।

অনেক রকম নেশায় আসক্ত বাংলাদেশিরা। তরুণদের মধ্যে বেড়েছে মাদকের নেশা আর ‘অসহায়’ জনগণের মধ্যে বেড়েছে প্রতিশোধে হত্যার নেশা। আইন ও প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ বিচার ছাড়া যেকোনো হত্যাকাণ্ডই অপরাধ—এই ধারণায় যাঁরা বিশ্বাস করেন না, তাঁরা আসলে তাঁদেরই মৃত্যুপরোয়ানা তুলে দেন অজ্ঞাতনামা খুনিদের হাতে। এমনটাই যদি অনেকের কাছে মনে হয়, তাহলে সমাজে নিরাপত্তা বাড়বে, নাকি প্রতিষ্ঠা হবে অস্ত্রধারীদের শাসন!

নুসরাত থেকে রিফাত—অধিকাংশ ঘটনায়ই খুনিদের সম্পর্ক মাদক ও মাফিয়ার সঙ্গে। খুনিদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা ও থানা-পুলিশের সম্পর্ক। এক খুনির হাত থেকে বাঁচতে আমরা কি অসাধু নেতা ও বিপথগামী বন্দুকধারীদের হাতে খুন-খারাবির অধিকার তুলে দেব? যে দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিতন্ত্র সব সমস্যার মূলে, তাদের বেলায় কী করা হবে? আইন ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ও কার্যকর করতে পারে জোরদার নাগরিক নজরদারি এবং ঐক্যবদ্ধ জনতা।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ বাংলাদেশে নাগরিক নিরাপত্তা বিষয়ে আশঙ্কা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি এমন অবস্থা আসে, যেখানে হাজার হাজার লোক বিনা বিচারে আটক হচ্ছে, হাজার হাজার লোক কাস্টডিতে থাকা অবস্থায় মারা পড়ছে, সে অবস্থা ঠেকানোর কোনো প্রস্তুতি কি আপনাদের আছে?’ (২৪ জুলাই ২০০৬, সমকাল)। দল-মত না দেখে যে-কারও হত্যাকেই যদি আমরা সমানভাবে দেখি, তাহলেই কেবল আমরা জননিরাপত্তার দিকে এগোতে পারব।

যে দেশে অনেক ঘটনায় বিচারের আগেই শাস্তি হয়ে যায়, সেখানে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয়, তা আদালত ঠিক করছেন না, ঠিক করে দিচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা। এ জন্যই এর নাম হওয়া উচিত ‘ইচ্ছাখুন’। তাদের চোখে কিছু মানুষের আর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এই ধরনের মানুষকে বলা হতো হোমো সাসের। হোমো সাসেরদের হত্যায় অপরাধ হতো না, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো বালাই তাদের জন্য খাটত না। এমনকি তাদের মৃত্যু কখনো মহত্ত্বও পাবে না। তারা জড়বস্তু কিংবা নির্বাক প্রাণীদের মতো অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য রাষ্ট্র তৈরি করে রাখবে কিছু প্রতিষ্ঠান, যারা কাজ করে যাবে আইনের আওতার বাইরে, আবার আইনই তাদের দেবে দায়মুক্তি। এর নামই কি আইনের শাসন?

‘ক্রসফায়ার’পন্থী জনতার কেউ কি খেয়াল করেছেন, দেশে ‘ক্রসফায়ার’ যত বাড়ছে, হত্যা-খুন-ধর্ষণ ও দুর্নীতিও তত বাড়ছে? ‘ক্রসফায়ার’ তো বেশ কয়েক বছর  ধরে চলছে। তাহলে কেন অপরাধ কমল না? ‘ক্রসফায়ার’ যে মানুষের হাতে মানুষের খুনকে স্বাভাবিক করে তুলেছে, মানুষকে জীবন নেওয়ায় অভ্যস্ত করে তুলেছে, সেই জিনিসটা এই চটজলদি বিচারবাদীরা খেয়াল করেন না। ‘ক্রসফায়ার’ যে এক রক্তপিপাসু জাতি তৈরি করেছে, সেই জাতির এক সন্তান চাপাতি-রামদা দিয়ে খুন করবে আর তার বদলা হিসেবে আরেক সন্তান বন্দুক দিয়ে গুলি করে তাদের মারবে, চোখের বদলে চোখ নেওয়ার এই নীতিতে যে আমরা সবাই ক্রমেই চোখ খুইয়ে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, সেই হুঁশ কি আছে?

ভুল রাস্তায় জোর কদমে হাঁটাহাঁটি করলে শক্তি খরচ ছাড়া আর কিছু হয় না। গত বছরের মাঝামাঝি মাদক নির্মূলে সরকার ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শুরু করল। এই যুদ্ধের প্রথম ১৩ দিনে ৯১টি লাশ পড়েছে। এর মধ্যে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামও নিহত হলেন। কেউ কি বুকে হলফ দিয়ে বলতে পারবেন, মাদকের বিস্তার বা ব্যবসা কমেছে। মৌমাছির চাক অটুট রেখে এদিক-ওদিক কয়েক শ মৌমাছি মারায় রানি মৌমাছি ভয় পায় না। তারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়।

মাদকযুদ্ধে পোড়খাওয়া কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট সিজার গাভিরিয়ার কথা আর ফেলা যায় না। ১৯৯০-৯৪ সাল পর্যন্ত তাঁর আমলে কলাম্বিয়ায় বিরাট মাদকবিরোধী অভিযান চলে। এই যুদ্ধে অস্ত্র, টাকা, গোয়েন্দা দিয়ে পাশে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের এক নম্বর মাদকসম্রাট পাবলো এসকোবারকে তিনি আটক করেন, মাদকচক্রকে আটকে রাখার জন্য বিরাট জেল বানান, এসকোবার জেল থেকে পালালে তাঁকে হত্যাও করান।

কিন্তু গাভিরিয়া কী লিখেছেন দেখুন: ‘বেআইনি মাদক জাতীয় নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয়, কিন্তু এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুধু সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে জেতা যায় না। আরও বেশি সেনা ও পুলিশকে মাদকের বিরুদ্ধে লাগালে টাকার অপচয় তো হয়ই, সমস্যাটা আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। অহিংস প্রতিবাদী ও মাদকসেবীদের জেলে ভরার ফল হলো উল্টো, সংগঠিত অপরাধী চক্র আরও শক্তিশালী হলো...মাদক চক্র ও মাদক দূর করার লাগাতার অভিযানে আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢাললাম। ...আমাদের মাদকবিরোধী ক্রুসেডে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ গেল, অনেক উজ্জ্বল রাজনীতিবিদ, বিচারক, পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিক (মাদক চক্রের হাতে) প্রাণও দিলেন। কিন্তু হলো কী? মাদক চক্র বিপুল অর্থ ঢেলে প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইনপ্রণেতাদের কিনে ফেলল।’

এহেন যুদ্ধ ফিলিপাইন থেকে বাংলাদেশ; কম উন্নত, কম গণতান্ত্রিক এবং বেশি দুর্নীতির দেশগুলোয় কেন ছড়াচ্ছে? গাভিরিয়ার স্বীকারোক্তি, আসল কাজ না হলেও এতে সরকারের জনপ্রিয়তা সাময়িকভাবে বাড়ে। কিন্তু অটুট থেকে যায় দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দুর্নীতিতন্ত্র। দেখা যাবে, এদের আশ্রয়েই থাকে অধিকাংশ অপরাধী। সেই তাদের হাতেই ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে নির্বিচার হত্যার অধিকার তুলে দেওয়া কতটা আত্মঘাতী কাজ, তা আরেকবার ভেবে দেখুন।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]