গুঁড়া দুধের আমদানি শুল্ক বাড়ানো সমাধান নয়

প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের দুগ্ধশিল্প খাত এগিয়ে যাচ্ছে
প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের দুগ্ধশিল্প খাত এগিয়ে যাচ্ছে

বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য গ্রহণযোগ্য মানের দুধের উৎপাদন বাড়িয়ে দুগ্ধ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এই খাতের উন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলন হলো সম্প্রতি অনুমোদিত প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধ উন্নয়ন প্রকল্পটি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করার জন্য তাদের প্রয়োজন দুগ্ধ খাতের সবার কাছ থেকে সঠিক তথ্য ও সহযোগিতা। কিন্তু শুল্ক বাড়ানোর দাবিতে খামারিদের সাম্প্রতিক কিছু কাজকর্মও (রাস্তায় আন্দোলন এবং দুধ রাস্তায় ঢেলে ফেলে দেওয়া) বর্তমান সময়ে দুগ্ধ খাতের জন্য মূল উদ্বেগের বিষয়।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (২০১৮) মতে, বাংলাদেশ বছরে ৯০ লাখ ৪০ হাজার টন দুধ (প্রয়োজন ১ কোটি ৫৪ লাখ টন) উৎপাদন করে। ইন্টারন্যাশনাল ফার্ম কম্পারিজন নেটওয়ার্কের (আইএফসিএন) মতে, বাংলাদেশ বছরে সর্বমোট ৮০ লাখ ৮০ হাজার টন দুধ উৎপাদন করতে পারে। এর মানে হলো, বাংলাদেশ তার মোট প্রয়োজনের ৬৩ শতাংশ দুধ (আইএফসিএনের মতে ৫৪ শতাংশ) উৎপাদন করতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো—বিবিএসের (২০১৮) মতে, বাংলাদেশ ১১ হাজার টন দুধ আমদানি করে, ফলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, ৬৭ শতাংশ (স্থানীয় উৎপাদন এবং আমদানি) এবং আইএফসিএনের মতে, ৫৯ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন থেকে বাংলাদেশ কতটা দূরে? ২০৩০ সাল পর্যন্ত হিসাব করলে বাংলাদেশের আরও ৬০ লাখ টন দুধ প্রয়োজন। এই ঘাটতির আরও ৬০ লাখ টন যোগ হয়ে পরবর্তী ১২ বছরে বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখ টন দুধ উৎপাদন করা প্রয়োজন। দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো জমির প্রাপ্যতা, গবাদিপশুর পর্যাপ্ত খাবারের অভাব এবং গরুর স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতা। সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন না করলে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা বাংলাদেশের জন্য বেশ কঠিন হবে।

শুধু আমদানি শুল্ক বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্র যেভাবে শিরোনাম করেছে, তার কারণ বোধগম্য না। শুল্ক-সম্পর্কিত কাজগুলো প্রকৃত উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। শুল্ক কমালে জাতীয় সার্বিক উন্নয়ন ও ভোক্তাদের সুবিধা বাড়বে। আর শুল্ক কমালে পারিবারিক ব্যবসা ছাড়া ছোট পরিসরের খামারিদের আয় কমে যাবে। বর্তমানে স্কিমড গুঁড়া দুধের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই পরিমাণ একই আছে, কিন্তু খামারিরা তা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করার দাবি করছেন। কিন্তু বাস্তবে দুগ্ধখামারিদের আয় বৃদ্ধি নির্ভর করে দুধের উৎপাদন খরচ কমার ওপর, শুল্ক বাড়ানোর ওপর নয়। বিশ্বব্যাপী দুধের গড় দামের চেয়ে বাংলাদেশের দুগ্ধখামারিরা ৩৭ শতাংশ বেশি মূল্য পান। যদিও ছোট খামারিদের উৎপাদন খরচ বেশি হয় বলে তাঁদের লাভের পরিমাণ বেশি হয় না। দুধের দাম বাড়ানো বা আমদানি শুল্ক বাড়ানোর চেয়ে উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে খরচ কমানোর বিষয়ে খামারিদের বেশি তৎপর হওয়া উচিত। শুল্ক বাড়ানো খামারিদের জন্য ভালো হতে পারে, কিন্তু এতে খরচ কমানো এবং দুধের মানোন্নয়নের মতো বিষয়গুলোর কোনো সমাধান হবে না। অন্যদিকে, শুল্ক বাড়ানো হলে ভোক্তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং এর ফলে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার সক্ষমতা কমবে।

‘ভোক্তারা হলেন নতুন সিইও এবং খামারি ও প্রক্রিয়াজাতকারীদের ওপর তাঁদের প্রভাব আছে’—উক্তিটি করা হয়েছিল গত ১৫-১৯ জুন বার্লিনে অনুষ্ঠিত ১২তম ইন্টারন্যাশনাল ফার্ম কম্পারিজন নেটওয়ার্কের (আইএফসিএন) ডেইরি কনফারেন্সে। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৪৮টি দেশ থেকে ৮৫ জন দুগ্ধ গবেষক অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে এ–ও বলা হয়েছিল যে নিম্নমান এবং দুধের উচ্চ মূল্যের কারণে ভোক্তারা ‘বিকল্প দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্যে’র প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এ থেকে বোঝা যায়, দুগ্ধখামারি ও প্রক্রিয়াজাতকারীদের ওপর ভোক্তাদের প্রভাব অনেক বেশি এবং দুগ্ধ খাতের উন্নয়ন করতে হলে ভোক্তাদের চাহিদার দিকে লক্ষ রাখতে হবে।

শুল্ক বাড়ানো, নাকি কমানো দুগ্ধ খাতের প্রতিযোগিতা বাড়াতে ভূমিকা রাখবে—এই প্রশ্নে এক সাম্প্রতিক গবেষণায় পরিষ্কার দেখা যায় যে শুল্ক ১০ শতাংশ কমালে খামারিরা ছোট পরিসরে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, কিন্তু মাঝারি ও বড় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। অন্যদিকে, ১০ শতাংশ বাড়ালে ভোক্তা ও দেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে সুবিধা পাবে এবং এর ফলে দুধের ব্যবহার বাড়বে। বর্তমানে দুধের ব্যবহার কমছে, এর প্রধান কারণ তরল দুধের উচ্চ মূল্য ও নিম্নমান।

দুগ্ধখামারিদের সাম্প্রতিক আন্দোলন করে রাস্তায় দুধ ঢেলে ফেলা সরকারের কাছে নিজেদের অবস্থা তুলে ধরার কার্যকর কোনো উপায় নয়। এর ফলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি (অর্থ ও সময়) হবে। তা না করে তাঁদের নিজেদের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং দক্ষতা বাড়ানো উচিত।

আন্তর্জাতিক দুগ্ধ কোম্পানি বা আমদানিকারকদের একদিকে স্থানীয় দুগ্ধ উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হবে, অন্যদিকে সরকারকেও তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে ন্যায্য ভূমিকা রাখতে হবে। ঠিক একইভাবে স্থানীয় ব্যবসা সম্প্রসারণেও সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। দেশের দুগ্ধ খাতের উন্নয়নে সব অংশীদারকে একত্র হয়ে কাজ করতে হবে। খামারিদের দায়িত্ব নিজেদের দক্ষতা বাড়ানো, দুধের উৎপাদন খরচ কমানো এবং দুধের ভেজাল প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। গবেষক ও শিক্ষাবিদদের সরকারের জন্য কৌশল বের করতে হবে, যেন সরকার দুগ্ধ খাতের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। সব ধরনের উন্নয়নকাজ যেন ঠিকভাবে হয়, তা নিশ্চিত করার করার প্রধান কার্যকরী শক্তি সরকার। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক (আইডিআরএন) গত বছর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মানির ইন্টারন্যাশনাল ফার্ম কম্পারিজন নেটওয়ার্কের সঙ্গে যৌথভাবে ডিপার্টমেন্ট অব অ্যানিমেল নিউট্রিশন প্রতিষ্ঠা করে। আইডিআরএন দুগ্ধ খাতের অংশীদারদের একত্র করতে কাজ করছে, যেন দুগ্ধ খাতের উন্নয়নে সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।

এভাবে এটি পরিষ্কার যে দুগ্ধ খাতের উন্নয়নের জন্য শুধু আমদানি শুল্কের ওপর গুরুত্বারোপ না করে দুগ্ধ খাতের সব অংশীদার যেন তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে।

. মো. মহিউদ্দিন: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল নিউট্রিশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]