ছাত্রসংগঠনগুলোর হালচাল

নির্বাচনের তফসিল ও বয়সসীমা বাতিলের দাবিতে ছাত্রদলের বঞ্চিত কমিটির নেতা–কর্মীদের বিক্ষোভ
নির্বাচনের তফসিল ও বয়সসীমা বাতিলের দাবিতে ছাত্রদলের বঞ্চিত কমিটির নেতা–কর্মীদের বিক্ষোভ

একসময় লীগ বলতেই মুসলিম লীগ বোঝাত। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে লবণের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। ১৫-১৬ টাকা সের (এক কেজির সমপরিমাণ)। স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল দুই আনা সের। তখন লীগবিরোধী প্রচার তুঙ্গে। নেতৃত্বে শেরেবাংলা। তাঁর ভক্ত বিডি হাবিবুল্লাহ গান লিখতেন। শেরেবাংলা জনসভায় বরিশালে কর্মী রাজ্জাককে বললেন, ‘গানডা গাও দেহি’। তো গানটি গাওয়া হলো:

লীগ শাসনের গুণ কেমন

ছয় শ টাকা নুনের মণ

হায় রে আজব লীগের বাহানা।

নির্বাচনে আমজনতার ভোট পেতে এ ধরনের প্রচারণার জুড়ি নেই। মুসলিম লীগ এখন ইতিহাসের জাদুঘরে। মুসলিম লীগের গণতন্ত্রায়ণের দাবিতে তৈরি হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ‘আওয়াম’ উর্দু-ফারসি শব্দ। এর বাংলা জনগণ। অর্থাৎ, সরকারি মুসলিম লীগের পাল্টাপাল্টি জনগণের মুসলিম লীগ তৈরি হলো। সেই দলের নাম থেকে কয়েক বছর পর ‘মুসলিম’ শব্দটি খসে পড়েছিল। দল চালু থাকল আওয়ামী লীগ নামে। এখন লীগ বলতে আওয়ামী লীগই বোঝায়।

একসময় আওয়ামী লীগ এ দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল ছিল। পঁচাত্তরের আগস্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তৈরি হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি—বিএনপি)। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলেরই আছে অনেক অঙ্গসংগঠন। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর নামের শেষে ‘লীগ’ থাকে। বিএনপির অঙ্গসংগঠনগুলোর নামের শেষে থাকে ‘দল’। নাম দেখেই বোঝা যায় কোনটি কোন গ্রহের উপগ্রহ। ইদানীং পথে–ঘাটে নতুন নতুন অঙ্গসংগঠন গজিয়ে উঠেছে, যাদের নাম দলের গঠনতন্ত্রে নেই। যেমন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া পরিষদ ইত্যাদি। নেতার নাম জুড়ে দিলেই কিংবা নামের শেষে ‘লীগ’ বা ‘দল’ থাকলেই এটি কোন বর্গের, তা বোঝা যায়। এদের ব্যানার-পোস্টার সব জায়গায় চোখে পড়ে।

দুই দলেই আছে অসংখ্য তরুণ, তাঁরাই দলের মূল খুঁটি। নেতারা তাঁদের খুব একটা ঘাঁটাতে চান না। একদিকে আছে ছাত্রলীগ, অন্যদিকে ছাত্রদল। এরা কারণে-অকারণে প্রায়ই সংবাদ শিরোনাম হয়। লাঠিসোঁটা, বন্দুক-পিস্তল কিংবা চাপাতি-কিরিচ হাতে তাদের প্রকাশ্য মহড়া ও যুদ্ধ দেখা যায় রাস্তায়। সিটিজেন জার্নালিজমের কল্যাণে অনেক বেরসিক সাংবাদিক অস্ত্র হাতে এদের ছবি সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়ে দেন।

ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব প্রাচীনকালে কাউন্সিল সভার মাধ্যমে ছাত্ররাই নির্বাচন করতেন। এখন এই নিয়ম আর নেই। এখন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার যুগ। গণতন্ত্রের কতটুকু চর্চা হয়, জানি না। তবে কেন্দ্রিকতা আছে শতভাগ। অঙ্গসংগঠনের কমিটি এখন ঠিক করে দেন মূল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। নেতৃত্বে বিভেদ বা টানাপোড়েন থাকলে তার প্রভাব দেখা যায় ছাত্রসংগঠনের মধ্যকার বিভাজন বা হাঙ্গামায়। সম্প্রতি এটি ভালোভাবেই ঘটেছে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলে।

ছাত্রলীগ এখন ক্ষমতাসীনদের বলয়ে। তাদের হাতে অনেক ক্ষমতা। কমিটিতে থাকা মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। পদ না পাওয়া মানে ইহকাল একেবারেই ঝরঝরে। এখন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা ‘আন্দোলন’ করছেন। বেশ কয়েকজন অনশনেও গেছেন। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁরা ঘোষণা দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগসহ চার দফা দাবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাস্তবায়িত না হলে তাঁরা আমরণ অনশন করবেন (সূত্র: প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০১৯)।

ছাত্রদলের পুরোনো কমিটি ভেঙে দেওয়ায় অনেকেই নাখোশ। তাঁরা বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন। ছাত্রদলের কমিটিতে থাকার জন্য বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ায় অনেকেই বাদ পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছেন। বয়সসীমা তুলে দেওয়া ও কাউন্সিলের তফসিল বাতিলের দাবিতে লাঠিসোঁটা এবং ক্রিকেটের স্টাম্প নিয়ে বিএনপি অফিসের সামনে মহড়া দিয়েছে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী। গত বৃহস্পতিবার তারা বিএনপি অফিসের একটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা ভেঙে ফেলে, বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয় এবং অফিস লক্ষ্য করে ডিম ছুড়ে মারে (সূত্র: ওই)। বিএনপি নিজেদের একটি ‘নির্যাতিত’ দল মনে করলেও এটি আগে কয়েক মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল এবং ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় যাওয়ার আশা রাখে। সুতরাং পদ–পদবির লড়াই চলছে, চলবে। পদ মানেই ক্ষমতা এবং নানান প্রাপ্তি।

ছাত্রসংগঠনের প্রসঙ্গ মানেই ছাত্ররাজনীতি। এ বিষয়ে গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী ও তাঁর একসময়ের শিক্ষক অধ্যাপক আহমদ শরীফের আলাপচারিতার কথা মনে হলো। প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় এখানে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি:

আবুল আহসান চৌধুরী: আমাদের শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাসী-নৈরাজ্য-অবক্ষয় চলছে, তার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

আহমদ শরীফ: শিক্ষাঙ্গনে কোনো সন্ত্রাস-নৈরাজ্য নেই, আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে আছে। তারা গুন্ডা জোগাড় করেছে টাকা দিয়ে ছাত্রকে। তারা তাদের উপদল বলে না কী বলে—মানে ছাত্র ফ্রন্ট আরকি—বাংলায় কী বলে—অঙ্গদল—অঙ্গদল হিসেবে কালকে থেকে যারা তাদের ছাত্র অঙ্গদল–যুব অঙ্গদল—চল্লিশ বছর পর্যন্ত যুব থাকে—অঙ্গদল তুলে দিক, সন্ত্রাস মুহূর্তে চলে যাবে। পয়সা না দিলে কে কার জন্য মারামারি করে? কেউ করে না।

আহসান: তাহলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে আপনার ধারণা কি নেতিবাচক?

শরীফ: কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজনীতি করে পয়সা পেয়েই এবং আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো গুন্ডা পোষণ করে বলে, পয়সা দিয়ে পালন করে বলে, তাদের খুনি বানায় বলেই তারা মাস্তান-খুনি-গুন্ডা হয়েছে। কালকে তারা এটা বন্ধ করে দিলে আর হবে না। তার একটা প্রমাণ, তুমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছ, তুমি দেখেছ, ইলেকশন না থাকলে কোনো দলীয় চেতনা হলে-হোস্টেলে তুমি দেখোনি। ইলেকশন আসলে দলীয় চেতনা হতো। এখন তো পয়সা দিয়ে দলীয় চেতনা এনেছে। কাউকে খুন করার জন্য হাইকমান্ড থেকে, দলপ্রধান থেকে, দলের পক্ষ থেকে খুন করবার জন্য আদেশ দেয়, মারামারি করার জন্য আদেশ দেয়, টাকা যত লাগে। এতেই প্রলুব্ধ হয়। প্রথমত, সে ক্যাশ টাকা পায়। সেটা দিয়ে সে চায়নিজ খেতে পারে, মদ খেতে পারে, আরও অন্য অপকর্ম করতে পারে। দ্বিতীয় হচ্ছে, একটা ভরসা—কোনোরকমে যদি প্রাণে বেঁচে যায়, তাহলে একটা ব্যবসা ফাঁদানো যাবে, একটা চাকরি পাওয়া যাবে। পেয়েছে না! অনেকে পেয়েছে। এই কারণে ওদের প্রলুব্ধ করে আনে। কাজেই শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিষয়ে কথাটা যেভাবে বলছ, কথাটা সেভাবে সত্য নয়। শিক্ষাঙ্গনে কোনো সন্ত্রাস নেই। দেশের মধ্যে কোনো সন্ত্রাস নেই। সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, পয়সা দিয়ে জিইয়ে রেখেছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো যদি আজকেই বলে দেয়, বিএনপি যদি আজকেই বলে দেয়, আমাদের আজ থেকে কোনো অঙ্গদল থাকবে না, ছাত্র-যুব অঙ্গদল থাকবে না; জামায়াতে ইসলামী বলে দেয়, ছাত্র-যুব অঙ্গদল থাকবে না; আওয়ামী লীগ যদি বলে অঙ্গদল থাকবে না; কাল থেকে মারামারি বন্ধ।

আহসান: একসময় তো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে সুস্থ রাজনীতি ছিল?

শরীফ: এখনো থাকবে, চিরকাল থাকবে।... যেমন চরাঞ্চলে গুন্ডা জোগাড় করে পয়সা দিয়ে লাঠিয়াল জোগাড় করে চর দখল করে। এটা তো ভাড়াটে কাজ। এটা তো পলিটিকস নয়। এই যেমন ছাত্ররা মাও সে তুংয়ের জন্মবার্ষিকী করেছে, গঞ্জালেসের মুক্তি দাবি করেছে। সেটা যে সে জিনিস নয়। দুনিয়ার মজদুর এক হও বলে যে স্লোগান দেয়, সেটা ছাত্রদলীয় নয়, এটা হচ্ছে বিবেকের। সেটা দেশের ভেতরে হোক, দেশের বাইরে হোক (সূত্র: আলাপচারী আহমদ শরীফ, আগামী প্রকাশনী, ২০১৭)।

আহমদ শরীফের চাঁছাছোলা মন্তব্যগুলো ভাবায়। মূল রাজনৈতিক দল এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে আছে প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক। নামে ছাত্রসংগঠন হলেও এগুলো এখন রাজনৈতিক দলের শিক্ষাঙ্গনভিত্তিক শাখা। একটি পদ পাওয়ার জন্য মানুষ কত মরিয়া হতে পারে, ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সাম্প্রতিক উদাহরণ টানলেই বোঝা যায়। ৩০-৪০ জনের কমিটি বাড়িয়ে ৩০০-৪০০ জন করেও কূল পাওয়া যাচ্ছে না। সবাইকে জায়গা দিতে আরও কত অঙ্গদল তৈরি করতে হবে, কে জানে!

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]