স্তালিন: নাটক না উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচারণা?

সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমিতে স্তালিন নামে একটি নাটক হয়ে গেল। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার এটির প্রযোজনা করেছে। অনুবাদ করেছেন রায়হান আখতার। নির্দেশনা দিয়েছেন কামালউদ্দীন নীলু। নাটকটি মঞ্চায়নের পর ঐতিহাসিক সত্যের কিছু অপব্যাখ্যা থাকায় দর্শকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। নাটকটির ভূমিকায় লেখা হয়েছে, ‘স্তালিন মনে করতেন মৃত্যুই সব সমস্যার সমাধান, মানুষ যদি না থাকে তাহলে কোনো সমস্যাই থাকবে না।’

নাটকের প্রথমেই আমরা দেখি আইজেনস্টাইনের সিনেমা দেখে স্তালিন ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। আইজেনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পটেমকিন বা অক্টোবর: টেন ডেইজ দ্যাট শক দ্য ওয়ার্ল্ড-এর মতো সিনেমা বিশ্বের তাবৎ বিপ্লবী এবং দর্শকদের কাছে বড় অনুপ্রেরণা। গণজাগরণে সিনেমার যে শক্তি, তা তিনি যেমন প্রমাণ করেছেন, তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এই শক্তি ব্যবহারও করেছে। স্তালিন যে তাঁর ছবি দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তার প্রমাণ নির্দেশক কোথা থেকে পেলেন? দেখা যাচ্ছে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্তালিন শুধু মদ খাচ্ছেন, টেবিলের ওপর হাঁটছেন এবং হত্যার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। সময়টা পেলেন কোথায়?

লেনিন মারা গেছেন ১৯২৪ সালে। তারপর স্তালিন হাল ধরেছেন বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নের। সর্বক্ষণ ব্যস্ত থেকেছেন দেশি এবং বিদেশি ষড়যন্ত্র ঠেকানোর কাজে। এর মধ্যে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি। স্তালিন তখন লেনিনের নিউ ইকোনমিক পলিসির কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। গড়ে তুলছেন কল-কারখানা, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, নাট্যশালা, চলচ্চিত্রশিল্প ও চলচ্চিত্র শেখার স্কুল, দেশকে বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী। ১৯৩০-এর দশকে ভয়াবহ মন্দা, দুর্ভিক্ষ চলছে। রবীন্দ্রনাথ এ সময় রাশিয়া ভ্রমণ করেন। তিনি কৃষক-শ্রমিকের উন্নতি ও শিক্ষাব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন, অবশ্য লৌহ যবনিকার কথাও বলেছেন। সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র সোভিয়েত ইউনিয়ন।

নাটকে মার্শাল ঝুকভের ব্যাপারেও অসত্য তথ্য রয়েছে। ঝুকভ ১৩ বছর বয়সে জারের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বিপ্লবের পরে তিনি ১৯২০ সালে যোগ দেন সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে। একজন অত্যন্ত কৃতী সামরিক অফিসার হিসেবে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মার্শাল পদে উন্নীত হন ১৯৪১ সালে। ঝুকভ স্তালিনের কাছাকাছি আসেন ওই সময়েই। এর আগে তিনি স্তালিনের সঙ্গে বসে ষড়যন্ত্র করার সময় পেলেন কোথায়? অসম সাহসিকতার সঙ্গে এই দেশপ্রেমিক সৈনিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের মোকাবিলায় অনেক ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। স্তালিনের মৃত্যুর পরও তিনি সম্মানজনক সব পদে কাজ করেছেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। একজন সত্যবাদী সৈনিকের মতোই তাঁর লেখা আত্মজীবনীতে স্তালিন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে লিখে গেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, স্তালিন শুধু বিশ্বযুদ্ধ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না, তাঁকে দেশের সর্বত্র খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অস্ত্রের জোগান—সব বিষয়েই ভাবতে হচ্ছে। এই সময়গুলোতে তিনি দেশপ্রেমিক জনগণ ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যেভাবে কাজ করেছেন, তা অতুলনীয়। স্তালিন নাটকে তার কিছুই দেখা যায়নি।

স্তালিন মৃত্যুকেই যদি একমাত্র সমাধান ভাবতেন, তাহলে সারা বিশ্বকে নাৎসিদের হাতে ছেড়ে দিলেই পারতেন, এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নকেও। নাটকে মায়াহোল্ডের বিষয়টি এসেছে। বিষয়টিতে প্রশ্ন দেখা দেয় এই কারণে যে, সারা বিশ্বে যাঁরা রাজনৈতিক থিয়েটার করেন, তাঁদের কাছে তিনি শিক্ষক। বের্টোল্ট ব্রেখট থেকে শুরু করে অনেকেই তাঁর অনুসারী। জনগণের থিয়েটার যিনি করেন তাঁকে কেন এভাবে হত্যা করতে হবে? এখানে অন্য কোনো বিষয় আছে কি না, তা–ও ভাবতে হবে। কারণ, স্তালিনের অজান্তে বা ভুল তথ্যের কারণেও অনেক কিছু ঘটা অসম্ভব নয়।

নাটকের এক জায়গায় বলা হয়েছে মাও সে–তুংকে স্তালিন হত্যা করতে চেয়েছেন। কিন্তু মাও সে–তুং কী বলেছেন? তিনি বলেছেন: ‘তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি (স্তালিন) যে অবদান রেখে গিয়েছেন, তা তুলনাহীন। তিনি ছিলেন আমাদের এই সম্পূর্ণ নতুন কালের প্রতিনিধি। তাঁর সঠিক নেতৃত্বের ফলেই সোভিয়েত জনতা এবং সারা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন।’

স্তালিনের মৃত্যুর পর কলকাতার লেখক পূর্ণেন্দু পত্রী ‘স্টালিনের রাত’ নামে একটি ছোটগল্প লিখেছেন। সেই গল্পে যেদিন স্তালিন মারা যান, সেই রাতে কলকাতার এক গৃহবধূ নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। এ তো গল্পের কথা। সত্য ঘটনাও কিন্তু আসছে অনেক জায়গা থেকে। চিলি, এল সালভাদর, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, আফ্রিকার কোনো এক শ্রমিক বা কৃষক কাজ করতে করতে থমকে দাঁড়িয়েছেন, নির্বাক হয়ে গেছেন এই মহান মানুষের মৃত্যুতে।

যাই হোক, স্তালিন দেবতা নন, মানুষ। রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি, নতুন রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে অনেক ভ্রান্তি থাকতে পারে। সেগুলো নিয়ে যে নাটক রচনা করা যাবে না, তা–ও ঠিক নয়।

বিপুল অর্থ ব্যয়ে এই প্রযোজনা হয়েছে। বিশাল টিম। মঞ্চ নির্মাণের পরিকল্পনা একেবারে লাউঞ্জ থেকে। সব জায়গায় লাল কাপড় ও টুপি। দর্শকেরা টুপি পরছেন, ছবি তুলছেন আবার বিরতির সময় ফেরতও দিয়ে দিচ্ছেন। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্তালিন একটা ভাঁড়, মদ্যপ এবং সভাসদ নিয়ে নানা মশকরায় মত্ত। শেষে আবার বলেছেন মায়ের অভিলাষে তাঁর যাজক হওয়াই ভালো ছিল। বারবার তাঁর কন্যা সাভেত্লানার কথা বলা হচ্ছে। স্তালিনের কন্যা তো কমিউনিস্ট আদর্শের ছিলেন না। দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকে পিতার সমালোচনা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্তালিনের পুত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক; জার্মানদের কাছে ধরা পড়ার পর তাঁর বদলে একজন জার্মান জেনারেলকে ছেড়ে দিতে হবে, এই আবদার স্তালিন মানেননি। সৈনিকপুত্রের বদলে একজন সৈনিককেই ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন। এটাও স্তালিনের ভুল? নাটকে সেটাই প্রমাণ করার ইচ্ছা।

 নাটকটি দেখে অনেক দর্শকের কাছেই মনে হবে এ এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার। প্রপাগান্ডা কখনো আর্ট হয় না। তাহলে বিজ্ঞাপনচিত্র ও সরকারি প্রচারণা কার্যক্রম মহৎ শিল্প হয়ে উঠত। স্তালিন যুগ মানুষ ভুলে যায়নি, ফলে নাটকের অসত্য দিকগুলো ধরা পড়েছে। মানুষ এ–ও ভুলে যায়নি যে কী পরিমাণ অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান হয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে, সমাজতন্ত্র একটি নতুন অর্থনীতির জন্ম দিতে পারে।

মামুনুর রশীদ নাট্যব্যক্তিত্ব