রাহুল গান্ধীর হেঁয়ালি শেষ হচ্ছে না

রাহুল গান্ধী
রাহুল গান্ধী

এক মাস পেরিয়ে গেলেও যে হেঁয়ালি স্পষ্ট নয়, তার নাম কংগ্রেস, বা রাহুল গান্ধী। দলটা যে কী করবে, দলের সভাপতি যে কোন পথে হাঁটবেন, তা এখনো কেউ জানে না। এমন হতবুদ্ধি অবস্থা শতাব্দীপ্রাচীন দলটির আগে কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ছে না।

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ফল বেরোয় ২৩ মে। ২৫ মে ফল বিশ্লেষণ করতে ডাকা হয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। সেখানে সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিংসহ প্রায় সবাই হাজির। বৈঠক শেষে দলের পক্ষ থেকে জানানো হলো, বিপর্যয়ের পুরো দায় নিজের কাঁধে নিয়ে রাহুল গান্ধী সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটির প্রত্যেক সদস্য তাঁর সে ইচ্ছা খারিজ করে দিয়েছেন।

বিপর্যয়ের পর এভাবে দলের সভাপতির পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ কংগ্রেসের খুব চেনা এক চিত্রনাট্য। বিশেষ করে সভাপতির পদে যখন গান্ধী পরিবারের কেউ আসীন। রাজীব গান্ধীর সময় বারবার এমন ঘটেছে। ঘটেছে সোনিয়া গান্ধীর আমলেও। পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনুগতদের সমস্বরে ‘যেতে নাহি দিব’ আর্তি শোনা যেত। সেই আর্তি, যা কিনা ‘তাহলে সবকিছু রসাতলে যাবে’র মতো শোনাত, তা শুনে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরের পদাধিকারীরা গণ-ইস্তফা দিতেন, যাতে কংগ্রেস সভাপতি নতুন করে দলে নতুন রক্ত সঞ্চার করতে পারেন। কিছু মুখ রদবদল হতো। তারপর সবকিছু সেই আগের মতোই চলত। এবারেও রাহুল যখন তেমনই করলেন, মনে হয়েছিল, এটাও সেই চেনা চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি।

কিন্তু দিন যত কাটছে, ততই বোঝা যাচ্ছে, এবারের চিত্রনাট্য চরিত্রগতভাবে একটু আলাদা। কেননা, রাহুলের মতো আর কোনো কংগ্রেস সভাপতির গোঁ অতীতে এত দীর্ঘায়িত হয়নি।

এই এক মাসের মধ্যে রাহুল বিদেশে ঘুরে এসেছেন। শুরু হয়েছে সংসদের অধিবেশন। রাহুল লোকসভার নেতা হতেও রাজি হননি। নেতা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে। গোটা মাস ধরে দলের নেতারা রাহুলের মানভঞ্জনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাহুলের একটাই উত্তর, দলের সভাপতি হিসেবে বিপর্যয়ের সব দায় তাঁর। নতুন কেউ সভাপতি হোন। নতুন উদ্যমে দল পরিচালনা করুন। তিনি দলে থাকবেন সাধারণ কর্মী হিসেবে। সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাবেন দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে। এই সঙ্গে রাহুল একটা শর্তও চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি, তাঁর মা সোনিয়া কিংবা বোন প্রিয়াঙ্কা, পরিবারের কাউকেই কংগ্রেস সভাপতি করা যাবে না। ওয়ার্কিং কমিটি অন্য কাউকে বেছে নিক।

অবশ্য ভোটের ফল বেরোনোর পর থেকেই রাহুলের সমালোচনায় অনেকের নখ-দাঁত বিচ্ছিরিভাবে বেরিয়ে এসেছে। বাঘা বাঘা যেসব কলাম লেখক রাহুলের নেতৃত্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তাঁরাই এখন দেখছি ‘পরিবারতন্ত্রকে’ তুলোধোনা করে লিখছেন (টেলিভিশনেও বলছেন), কংগ্রেসকে দাঁড় করানো রাহুলের কম্ম নয়। তিনি এখনো নাবালক। অথচ গুজরাট বিধানসভার ভোটে বিজেপিকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর পর এঁরাই রাহুলের মধ্যে প্রথম ‘প্রকৃত নেতার’ সন্ধান পেয়েছিলেন। কর্ণাটক বিধানসভার ভোটের পর জনতা দলের কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপির বাড়া ভাতে ছাই ফেলার পর তাঁরা রাহুলের মধ্যে ‘রাজনৈতিক পরিপক্বতার’ ছাপ খুঁজে পেয়েছিলেন। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় বিজেপির হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর তাঁরা লিখেছিলেন, রাহুলের হাতে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ ‘সুরক্ষিত’। উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব প্রিয়াঙ্কা ও জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার হাতে তুলে দেওয়াকে তাঁদের ‘মাস্টার স্ট্রোক’ বলে মনে হয়েছিল। রাহুল যখন রাফালকে অস্ত্র করে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান দিতে শুরু করেন, তখন কেউ লেখেননি সেটা বুমেরাং হতে চলেছে। অথবা বলেননি, দরিদ্রদের বছরে ৭২ হাজার রুপি করে দেওয়ার ন্যূনতম আয় প্রকল্প (ন্যায়) চিড়ে ভেজাতে ব্যর্থ হবে। আজ ওই কলাম লেখকদের চোখে রাহুল ‘ভিলেন অব দ্য পিস’। কংগ্রেস কীভাবে জেগে উঠতে পারে, সেই জ্ঞান এখন তাঁরা দান করছেন। সেই সঙ্গে করছেন পরিবারতন্ত্রের বাপবাপান্ত।

রাহুল অনড় ও অনমনীয় হলেও দলের কান্ডারি এখনো তিনিই। বিভিন্ন রাজ্যের পদাধিকারীরা সরে যাচ্ছেন, যাতে রাহুল নিজের মতো করে দল ঢেলে সাজাতে পারেন। এখনো কংগ্রেস সভাপতির নামে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এআইসিসি। ওয়ার্কিং কমিটিও নতুন সভাপতি নির্বাচনের তাগাদা অনুভব করছে না। এই দোলাচল আর যা-ই হোক, দলের পক্ষে ভালো হতে পারে না। এই বছরের শেষ ও সামনের বছরের গোড়ায় মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড ও দিল্লি বিধানসভার নির্বাচন। সভাপতি না থাকার ইচ্ছা প্রকাশ সত্ত্বেও রাহুল এই রাজ্যগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। কোনো কোনো রাজ্যের দলীয় কমিটি ভেঙে দিচ্ছেন। কিন্তু কোনোটাই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে করছেন না। এতেও দলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। মনোবলও ঠেকেছে তলানিতে।

কংগ্রেস ও কংগ্রেসিদের কাছে গান্ধী পরিবার বহু দশক ঐক্যবদ্ধতার একমাত্র অনুঘটক। অস্বাভাবিক ও যুক্তিগ্রাহ্য না হলেও এটাই সত্য। গান্ধী পরিবারকেই দেশের আপামর কংগ্রেস কর্মী-নেতা ‘সুপ্রিম’ বলে মেনে এসেছেন। ‘ডাইনেস্টির’ প্রশ্ন তুলে তা থেকে কংগ্রেসকে বিচ্যুত করা চাট্টিখানি কথা নয়। বরং বেশির ভাগ কংগ্রেসিই মনে করেন, এই যুক্তি কার্যকর হলে বিজেপির লাভ আঠারো আনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা দরকার, রাহুল থাকুন না-থাকুন, সিদ্ধান্ত দ্রুত গৃহীত হোক। বিলম্ব শুধু ধোঁয়াশাই নয়, হতাশাও সৃষ্টি করছে।

রাহুল বলেছেন, সাধারণ কর্মী হিসেবে তিনি দলকে শক্তিশালী করবেন। সভাপতি পদে থেকে বা না থেকে যেভাবেই তিনি তা করুন, তাঁর সামনে দুটি উদাহরণ রয়েছে। প্রথমটা তাঁর দাদি ইন্দিরা গান্ধীর। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিন বছরের মাথায় ইন্দিরা কীভাবে ফিরে এসেছিলেন, তা তাঁর জানা। মানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে কীভাবে সাধারণের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেছিলেন, রাহুল তা নিশ্চয় জানেন। সেই পথে তিনি হাঁটতে পারেন। দ্বিতীয় উদাহরণ অন্ধ্র প্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেসের নবীন নেতা জগনমোহন রেড্ডির। জগনমোহনের বাবা ছিলেন কংগ্রেসের নেতা। তাঁর অকালমৃত্যুর পর জগনমোহনের সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একদিকে কংগ্রেস, অন্যদিকে রাজ্যের শাসক চন্দ্র বাবু নাইডুর সঙ্গে টক্কর দিয়ে জগনমোহন আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তার আগে যে সংগ্রাম তাঁকে করতে হয়েছে, যেভাবে রাজ্যে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পদযাত্রা করেছেন, তা সবার কাছেই উদাহরণ। রাহুল সেই পথেও হাঁটতে পারেন। শুরু করতে পারেন যে চার রাজ্যে বছর শেষে নির্বাচন, সেখান থেকেই।

কী করবেন তিনি, জানা নেই। জানা শুধু এইটুকুই, জীবনে শর্টকাট বলে কিছু নেই।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি