ড. হালিমা খাতুন ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর

হালিমা খাতুন
হালিমা খাতুন

ড. হালিমা খাতুন ছিলেন একাধারে ছড়াকার, ছোটগল্পকার, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক। ছিলেন ভাষাসৈনিকও। তিনি ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অগ্রপথিক। হালিমা খাতুন ও তাঁর সাথিদের জন্যই আমরা বাংলায় কথা বলতে পারছি।

হালিমা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ২৫ আগস্ট খুলনা জেলার বাগেরহাটে। তাঁর বাবা ছিলেন মৌলভি আবদুর রহমান ও মা দৌলতুন্নেসা। হালিমা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন খুলনা করোনেশন স্কুলে। এরপর যোগ দেন পিকে গার্লস কলেজে। তারপর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। ১৯৯৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

কাজ ছাড়া একমুহূর্ত থাকতেন না হালিমা খাতুন। বাসায় গেলে অবশ্য হাসিমুখে বরণ করে শুরু করতেন গল্প। আমি ও আমার স্ত্রী সুফিয়া সুলতানা মুগ্ধ হয়ে তাঁর গল্প শুনতাম। দিন-ক্ষণ-মাস-বছর উল্লেখ করে ঘটনার বর্ণনা করতেন।

হালিমা খাতুনকে আমরা খালাম্মা বলে ডাকতাম। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর একমাত্র মেয়ে বিশিষ্ট আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণীর মাধ্যমে। ২০০৫ সালে ‘অগ্রজ’ নামে একটি অনুষ্ঠান শুরু হয় এনটিভিতে। আমি ছিলাম সে অনুষ্ঠানের প্রযোজক আর প্রজ্ঞা লাবণী উপস্থাপক। ‘অগ্রজ’-এর কারণেই হালিমা খাতুনের ৭৮/সি ইন্দিরা রোডে নিয়মিত যাওয়া-আসা করতাম। আমরা এক সপ্তাহ না গেলে খালাম্মা অস্থির হয়ে যেতেন। ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করে আসতে বলতেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ছুটে যেতাম।

তিনি অল্পতেই খুশি হতেন। প্রায়ই বলতেন, একজন মানুষের থাকার জন্য দরকার একটা কামরা ও একটা ছোট্ট খাট।

খালাম্মা তাঁর এক বিবাহবার্ষিকীতে স্বামীর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন একটি কাঁসার মগ। আমার স্ত্রী ধুলাবালুতে রং পরিবর্তন হয়ে যাওয়া মগটিকে একটু তেঁতুলপানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিল। ঝকঝকে মগটির দিকে তাকিয়ে হালিমা খাতুনের সেকি আনন্দ! ছবির মগ পরিষ্কারের গল্প সবাইকে বলতেন। স্বামীর দেওয়া উপহারটি তিনি সব সময় মাথার কাছে রাখতেন।

প্রজ্ঞা আপা ছেলে তেপান্তরকে নিয়ে কানাডায় চলে গেলেন। নাগরিকত্ব পেলেন। তারপর যাওয়া-আসা করতেন। প্রজ্ঞা আপা যখন থাকতেন না তখন একমাত্র ছেলে সামিন শারারকে নিয়ে প্রায়ই খালাম্মার কাছে যেতাম। তিনি সামিনের সঙ্গে মজার মজার গল্প করতেন।

হালিমা খাতুন শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তিনি শিশুবান্ধব নানান কাজ করেছেন। বিনা পারিশ্রমিকে পথশিশুদের ইটের ছোট্ট টুকরো দিয়ে মাটিতে লিখে অ আ ক খ শেখাতেন। অনেক শিশুর কর্মের সংস্থান করে দিয়েছিলেন।

হালিমা খাতুনের লেখা বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। এসবের মধ্যে রয়েছে আত্মজীবনী, উপন্যাস, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, শিশুতোষ রচনা ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। পাখির ছানা, বাঘ ও গরু, বাচ্চা হাতির কাণ্ড, কাঁঠাল খাবো, হরিণের চশমা, সোনা পুতুলের বিয়ে বেবি ফ্রক গায়, ছবি ও পড়া, শিশুদের নিয়ে ভাবনাসহ অসংখ্য শিশুতোষ রচনা তিনি লিখেছেন। এর মধ্যে পাখির ছানা, কাঁঠাল খাবো, হরিণের চশমা, সোনা পুতুলের বিয়ে ঢাকার মারি কুরি স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়। লেখালেখির পাশাপাশি হালিমা খাতুন প্রচুর বই পড়তেন। শোয়ার ঘরের আলমারিগুলো ছিল বইয়ে ঠাসা। সেখান থেকে কিছু বই তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো এখন আমার কাছে পরম সম্পদ।

হালিমা খাতুন ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানা দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁর সরল চিন্তাভাবনা, সাধারণ জীবন আমাদের মুগ্ধ করত। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই নারী নিজের যা কিছু ছিল, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন।

প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে হালিমা খাতুন অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১), বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯), অনন্যা সেরা দশ পুরস্কার (২০০৫)। ভাষা আন্দোলনে অনন্য অবদানের জন্য তিনি এ বছর একুশে পদক (মরণোত্তর) লাভ করেন।

হালিমা খাতুন গত বছরের ৩ জুলাই ঢাকায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। গুণী মানুষটি আমাদের হৃদয়ে চিরকাল শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন।

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন: এনটিভির সাবেক নির্বাহী প্রযোজক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক