সংসদে 'আমি একটি কবিতা বলব!'

স্বরচিত গান পরিবেশনের সময় সংসদ সদস্য জাকিয়া তাবাসসুম। ছবিটি ইউটিউবের ভিডিও থেকে নেওয়া
স্বরচিত গান পরিবেশনের সময় সংসদ সদস্য জাকিয়া তাবাসসুম। ছবিটি ইউটিউবের ভিডিও থেকে নেওয়া

এক ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগের নাম ‘সুকুমার শিল্প’। এর সংক্রমণ একবার শুরু হলে এই জিনিস কুটুর কুটুর করে প্রথমে ‘কুটিরশিল্প’ হয়ে শিল্পবোদ্ধা গরিবের কুটিরে কুটিরে ঘোরে। তারপর সেখান থেকে তা গড়াতে গড়াতে খোদ জাতীয় সংসদের অধিবেশনকক্ষে পর্যন্ত ঢুকে পড়তে পারে। আর তা যখন সংসদ পর্যন্ত গড়ায় তখন উন্নয়ন, অবকাঠামো, স্কুল–কলেজের এমপিও, গরু–ছাগলের হাটের ইজারা—এসব অনেক সাংসদের কাছে নিতান্ত ‘তুচ্ছ ও জাগতিক’ বিষয় বলে প্রতীয়মান হতে শুরু করে। তখন মাননীয় সংসদ সদস্যদের কেউ কেউ হয়ে ওঠেন অতি সংবেদনশীল কবি, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, আবৃত্তিকারসহ নানান আকার-প্রকারের ‘শিল্পকার’। ক্ষণপ্রভা প্রতিভাধর সেই সাংসদদের স্বরচিত-বিরচিত, সুলিখিত-সুপঠিত গান ও কবিতা কালক্রমে কালজয়ী ‘সংসদীয় শিল্পকলা’ হয়ে ওঠে। সেই শিল্পকলার ‘ভিডিওচিত্রকলা’ মাঝেমধ্যে বার্ডফ্লু ভাইরাসের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। লোকজন সেই শিল্পকর্মের অমিত সম্ভাবনার ঝিলিক দেখে নির্মল বিনোদন পায়।

একাদশ সংসদের অধিবেশনে সম্প্রতি সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ জাকিয়া তাবাসসুম সংসদে স্বরচিত ও স্বসুরারোপিত একগুচ্ছ সংগীত স্বকণ্ঠে নিবেদন করেছেন। যন্ত্রানুষঙ্গহীন সেই ‘গীতরসধারা’ অন্তর্জালের মধ্য দিয়ে সিঞ্চিত হয়ে ‘সংসারধুলিজালে’ ধরা পড়েছে। ফেসবুকে গানগুলো ফিট পড়ার মতো উন্মাদনা নিয়ে হিট করেছে। তাবাসসুমের ধ্রুপদি কণ্ঠের মায়াবী কারুকাজ ও রাগ-রাগিণীর সৌকর্য মাননীয় ডেপুটি স্পিকারকে পর্যন্ত আন্দোলিত করেছে। গানের তালে তালে তাঁকে বার কয়েক মাথা দোলাতে পর্যন্ত দেখা গেছে। তাঁর অভিব্যক্তির মধ্যে ‘কানের কুহর দিয়া মরমে পশিল গো’ টাইপের উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি তাবাসসুমকে শুধু গান গাওয়ার জন্য অতিরিক্ত আরও এক মিনিট সময় দিয়ে সূক্ষ্ম শিল্পকর্মের প্রতি তাঁর নিবিড় সূক্ষ্মতর মমত্ববোধের নিদর্শনও রেখেছেন।

পরপর তিনখানা গান পরিবেশনের আগে তাবাসসুমের অনুমতি প্রার্থনার শিশুতোষ ভঙ্গিমা রেডিওযুগের স্মৃতিবিজড়িত সোনামণিদের কথা মনে করিয়ে দেবে: ‘আমার নাম টুনটুনি...আমি একটি কবিতা বলব...আমার কবিতার নাম...’

তাবাসসুমই যে প্রথম জাতীয় সংসদে সুকুমার বৃত্তির চর্চা করেছেন, তা মোটেও নয়। তাঁর বহু প্রতিভাধর পূর্বসূরি আছেন। তাঁরা সুযোগ পেলেই দুকলি গান বা দুছত্র স্বরচিত বা বিরচিত পয়ার শুনিয়ে সংসদের মধ্যে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক আবহ জারি রাখায় বিশেষ অবদান রেখে এসেছেন।

এই একাদশ সংসদেই নওগাঁ-২ আসনের সাংসদ শহীদুজ্জামান সরকার গত ফেব্রুয়ারিতে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদকে প্রশ্ন করেছিলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কবে নাগাদ নথিপত্র থেকে ‘ক্যাপিটেশন’, ‘গ্রান্ড’—এই জাতীয় টার্মগুলো পরিহার করবে? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ভূমিকার মতো করে মন্ত্রী বললেন, ‘হৃদয় যাঁর দ্বিধাহীন চৈতন্যে উদ্ভাসিত, আত্মা যাঁর সহস্র আত্মার মাঝে একীভূত, মত যার রক্তের নেশায় রক্তাক্ত, কুটি কুটি (কোটি কোটি) মানুষের রাজপথের মিছিল মানেই একুশে ফেব্রুয়ারি।’ আগের বাক্যগুলোর সঙ্গে পরের বাক্যের কোনো পারম্পর্য আছে কি না, তা যতই তর্কসাপেক্ষ হোক, মন্ত্রী মহোদয় সাহিত্যের ছোঁয়া রেখে কবিতার মতো করে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন সংসদে উপস্থিত প্রাজ্ঞজনকে মিটিমিটি হাসতে দেখা গেছে।

এই সংসদে ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই (নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর) এবং মুনা (সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সুবর্ণা মুস্তাফা) দুজনই আছেন। দুজনই প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আসাদুজ্জামান নূর আবৃত্তির মানুষ। তাঁর সাধারণ কথাও আবৃত্তির মতো শোনায়। সুবর্ণাও তা–ই। সুবর্ণা এই সংসদে নির্মলেন্দু গ‌ুনের ‘স্বাধীনতা শব্দটি কী করে আমাদের হলো’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছেন। তাঁর সেই আবৃত্তি সংসদের অনেককেই আবিষ্ট করেছে।

তবে এর আগের সংসদে আবৃত্তি করে সবচেয়ে বেশি নাম কামিয়েছিলেন বিএনপির সাবেক সাংসদ শাম্মী আক্তার। বিগত সংসদে তিনি হেলাল হাফিজের কবিতা ‘যার যেখানে জায়গা’ কবিতাটি বিপ্লবী কণ্ঠে আবৃত্তি করেছিলেন। ওই কবিতার শেষে একটি বিশেষণ পদের উল্লেখ ছিল। তা সংসদে উচ্চারণ করা প্রচলিত ভব্যতার বিচারে সূক্ষ্মরুচিবিরোধী। তবে শিল্পীর কাছে ‘অশ্লীলতা’ যেহেতু একটি আপেক্ষিক বিষয় এবং যেকোনো শব্দ বা অনুষঙ্গকেই তাঁরা যেহেতু পরিত্যাজ্য জ্ঞান না করার ঔদার্য চেতনায় ধারণ করেন, সেহেতু সংসদে সব কবিতাকেই তাঁরা পাঠযোগ্য ও মহার্ঘ জ্ঞান করেন। ‘বাচিকশিল্পী’ শাম্মী আক্তারও তাই অবলীলায় কবিতাটি নির্বিকারভাবে পড়ে ‘ধন্যবাদ মাননীয় স্পিকার!’ বলে বসে পড়েছিলেন।

আগের সংসদে এমন আরেকজন শিল্পীমনা সাংসদ ছিলেন। তিনি বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সদস্য রেহানা আক্তার রানু। তিনি বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়া কোনো চুদুরবুদুর চইলত ন।’ এই ‘চুদুরবুদুর’ শব্দটি নিয়ে সংসদে যথেষ্ট হইচই হয়েছিল। কার্যবিবরণী থেকে শব্দটি বাদ দেওয়ার দাবি তোলাও হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সেটিকে ‘কলোকোয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা মৌখিক বুলি সাব্যস্ত করে তা এক্সপাঞ্জ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

বিএনপির নিলুফার চৌধুরী এমপি ২০১১ সালের ২১ মার্চ ‘নাই, নাই, নাই’ বক্তব্যসর্বস্ব একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলেন। বিপ্লবী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বড় মনোহর বিনোদন দিয়েছিলেন তিনি।

একাধিকবার গান গেয়ে সংসদ মাত করেছিলেন মানিকগঞ্জের সাংসদ ও এই সময়ের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। তাঁর সেই সর্বজনবিদিত সুকণ্ঠে সংসদের অধিবেশন কক্ষে পিনপতন নীরবতা নেমে এসেছিল।

এর বাইরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কবি এরশাদ স্বরচিত কবিতা পাঠ করে বাংলার সমকালীন সমাজবাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালে এরশাদ একজন জনপ্রিয় গীতিকার ছিলেন। ‘আজকের চেষ্টা আমার’, ‘পথের পাশে অবহেলায় যাঁদের কাটে সকল সময়’—তাঁর লেখা এসব কালজয়ী গান তখন বিটিভিতে বাজত। তবে সংসদে তিনি কখনো স্বরচিত গানের কলি ভাঁজেননি—এই অপূর্ণতা হয়তো থেকেই যাবে।

গান, কবিতা, নৃত্য—এগুলো একেকটি কলা। সাগর কলা, সবরি কলা কিংবা ছলাকলা নয়, এগুলো শিল্পকলা। বেশ কয়েক বছর ধরেই গান ও কবিতা সংসদে প্রায় নিয়মিত ভিত্তিতে চলছে। গান ও কবিতার সঙ্গে নাটকের যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, তা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের জানা নেই। বোধের ঘাটতির কারণে সাংসদদের কবিতা ও সংগীত পরিবেশন সম্পর্কে তিনি ২০১৫ সালে উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘অনেক সময় আমাদের সংসদের কার্যক্রমকে পুতুলনাচের নাট্যশালা মনে হয়।’ এর পরের বছর কয়েকজন সংসদ সদস্য প্রশ্নোত্তর পর্বে সরলসোজা মনে কিছু প্রশ্ন করার পর ইফতেখারুজ্জামান পাবলিকের পয়সা খরচের খোঁটা দিয়ে বলেছিলেন, ‘জাতীয় সংসদে অধিবেশন চলাকালে প্রতি মিনিটে খরচ হয় ১ লাখ ১১ হাজার টাকা। সংসদ সদস্যদের সে বিবেচনা থেকেই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রশ্ন করা উচিত।’ তবে ইফতেখারুজ্জামান যা-ই বলুন, আমরা মনে করি, সংস্কৃতিচর্চার কাছে পয়সাকড়ি কিছু না—‘মানি ইজ ডাস্ট’, মানে হাতের ময়লা। অত্যন্ত ‘আহ্লাদের কথা’ হলো, সংসদে কবিতা ও গান—এই দুটি ললিতকলার ব্যবহারিক চর্চার নৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। বাকি আছে নৃত্যকলা। কবে সেখানে সেই পারফর্মিং আর্ট দেখতে পাব কে জানে!

সারফুদ্দিন আহমেদ: কবি ও সাংবাদিক।