রাজনীতি থেকে অর্থের প্রভাব কমানো সম্ভব

গত সপ্তাহে ঢাকায় এক সেমিনারে বিজ্ঞ বক্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য, সে কারণে এই সংসদ সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষার বদলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় অধিক আগ্রহী। খুবই ন্যায্য কথা। এক হিসাবে দেখছি, চলতি সংসদে মোট সদস্যের ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী। তো, শিয়ালের হাতে যদি মুরগির খোঁয়াড়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে তারা শিয়াল খেদানোর বদলে মুরগি সাবাড় করতেই অধিক আগ্রহী হবে—এ আর নতুন কী কথা। 

প্রবাদেই তো রয়েছে, শিয়ালকে মুরগি রক্ষার দায়িত্ব দেওয়ার আগে মনে রেখো আজ হোক বা কাল, শিয়াল বাবাজির কিন্তু খিদে পাবে। তখন? 

একটা সময় ছিল যখন রাজনীতি করাকে ‘পাবলিক সার্ভিস’ বা জনসেবা ভাবা হতো। যারা অন্য কাজকম্ম ফেলে ঝান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াত, তাদের দেখে লোকে বলত, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। সেসব দিন এখন আর নেই। এখন যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের লক্ষ্য থাকে বনের ওই মোষকে কী করে নিজের গোয়ালঘরে ঢোকানো যায়। আর হবেই বা না কেন? কী পরিমাণ মালকড়ি ঢালতে হয় নির্বাচনে জিততে, সে হিসাব করে দেখলেই ব্যাপারটা ফরসা হবে। শুধু নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করে ফরম পূরণ করতেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালতে হয়। এক নেতার কথা শুনেছি, এ বছরের সংসদ নির্বাচনের আগে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে ফরম বেচেই নাকি তিনি কোটি টাকা কামিয়েছেন। 

ব্যবসায়ীরা পুঁজি খাটান মুনাফা হবে বলে। ফলে আমাদের সাংসদেরা যদি গাঁটের পয়সা খরচ করে নির্বাচন করে শেষ পর্যন্ত জিতে আসেন, তাহলে নিজেদের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ ‘রিটার্ন’ নিশ্চিত করতেই তাঁরা সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। 

শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই এখন নির্বাচনী রাজনীতি মানেই টাকার খেলা। আমেরিকার কথা ধরুন। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, এ দেশে সিনেটের সদস্যপদের জন্য গড়পড়তা খরচার পরিমাণ প্রায় সোয়া কোটি ডলার। এটা হলো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের যাঁর যাঁর প্রচারণার খরচ। এর ওপর রয়েছে দলগত খরচ, সে হিসাব ধরলে প্রতিটি সিনেট আসনের পেছনে ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২ কোটি ডলার। কংগ্রেসের সদস্য পদের জন্য খরচার পরিমাণ অবশ্য কিঞ্চিৎ কম—গড়পড়তা ১৩ লাখ ডলার। 

বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রার্থীরা নিজের পয়সা খরচ করেই নির্বাচন করে থাকেন। তাঁরা জানেন, একবার নির্বাচিত হলে সে বিনিয়োগ সুদে-আসলে তুলে আনা কঠিন হবে না। আমেরিকায় অবস্থাটা ভিন্ন, এখানে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে নির্বাচন করেন, এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। প্রায় ক্ষেত্রেই নির্বাচন করা হয় চেয়েচিন্তে। খরচের মোটা অংশ ব্যয় হয় টিভিতে বিজ্ঞাপনের খরচ মেটাতে। নির্বাচনী প্রচারণায় নামার আগে মাথায় রাখতে হয় এই খরচ মেটানো হবে কোত্থেকে। প্রার্থীরা নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণার আগে যাঁর যাঁর মালদার সমর্থকদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে জেনে নেন কে কেমন মালকড়ি ফেলবে। দাতাদের কাছ থেকে এই সব চাঁদার আশ্বাস পেলে তবেই নির্বাচনে নামার কথা ভাবা যায়। 

রাজনীতিবিদদের মাথায় এই চিন্তাই ঘোরে, কী করে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য চাঁদা তোলা হবে। টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ বলেছেন, রাজনীতি করতে হলে সবার আগে নিজের লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ফেলতে হবে। কারণ, যার সঙ্গেই দেখা হবে বলতে হবে, গুড মর্নিং, ভালো আছেন তো? আমার জন্য দয়া করে কিছু চাঁদা দেবেন কি? 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা ধরুন। ২০১৬ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম দিন থেকেই তিনি পরবর্তী নির্বাচনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে যাচ্ছেন। গত মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রচারণা শুরু করার আগেই তিনি প্রায় ১০ কোটি ডলার চাঁদা সংগ্রহ করে ফেলেছেন। এই অর্থের মোটা অংশই এসেছে ওয়াল স্ট্রিটের ধনকুবেরদের কাছ থেকে। 

নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, নির্বাচনের আগে যাঁরা ভোট ভিক্ষায় নামেন, তাঁরা প্রতিশ্রুতি দেন নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবেন।
বাংলাদেশ বা আমেরিকায়, সব রাজনীতিকের ভাষাই এক। কিন্তু সমস্যা হলো, যাঁদের ট্যাঁকের জোরে তাঁরা নির্বাচিত হলেন, তাঁদের স্বার্থ রক্ষার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করবেন কী করে? ধনীর স্বার্থ রক্ষা করলে অন্য সবার স্বার্থ রক্ষা হয়, এ দেশে এমন কথাও বলতে শুনেছি। মনে আছে, জেনারেল মোটরস কোম্পানির প্রধান নির্বাহী চার্লস উইলসন তাঁকে কেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী করা উচিত, এই প্রশ্নের জবাবে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, জেনারেল মোটরসের জন্য যা ভালো, আমেরিকার জন্যই তা ভালো। 

এই অবস্থা বদল হওয়া দরকার। গণতন্ত্রের একটা মানে হলো, দেশ শাসনে সংখ্যাগুরু মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন। তারাই ঠিক করবে কে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসবে। কিন্তু টাকাই যখন সকল শক্তির উৎস হয়ে পড়ে, তখন গণতন্ত্র পিছু হটতে বাধ্য। 

এই অবস্থা পরিবর্তনের একটা পথ হলো রাজনীতি থেকে অর্থের প্রাধান্য ছেঁটে ফেলা। ছোট-বড় সব আসনের নির্বাচনের জন্য যদি রাষ্ট্রীয় খাত থেকে ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, তাহলে কিছুটা হলেও অর্থের প্রভাব কমবে। কল্পকাহিনি নয়, বর্তমানে আমেরিকার ১৪টি অঙ্গরাজ্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি পদের নির্বাচনে ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারি অর্থায়নের (পাবলিক ফিন্যান্সিং) ব্যবস্থা আছে। এ জন্য সবার আগে নির্বাচনের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা যাবে তার একটি সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ব্যয় নির্বাহে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে অ্যারিজোনা বা কানেটিকাটের মতো রাজ্যে সব প্রার্থীকে কমপক্ষে ২০০ সমর্থকের কাছ থেকে অনূর্ধ্ব পাঁচ ডলার চাঁদা সংগ্রহের পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতিদানে রাজ্য তহবিল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতি প্রার্থীকে নির্ধারিত নির্বাচনী ব্যয়ের পুরোটাই তুলে দেওয়া হয়। হাওয়াই বা ফ্লোরিডার মতো অঙ্গরাজ্যে ‘পাবলিক ফিন্যান্সিং’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সংগৃহীত চাঁদার সমপরিমাণ সরকারি অর্থ বা ম্যাচিং ফান্ড প্রদানের নিয়ম চালু রয়েছে। 

সম্প্রতি নিউইয়র্ক থেকে নির্বাচিত সিনেটর ক্রিস্টিন জিলিব্রান্ড রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব কমাতে একটি নতুন প্রস্তাব করেছেন। ডেমোক্রেটিক দলের যে ২৪ জন সদস্য এই দলের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য বাছাই পর্বে লড়ছেন, জিলিব্রান্ড তাঁদের একজন। তিনি প্রস্তাব করেছেন, প্রত্যেক ভোটারকে ভাউচার আকারে মাথাপিছু ৬০০ ডলার দেওয়া হবে, যা তাঁরা প্রেসিডেন্ট, সিনেট ও কংগ্রেসের নির্বাচনের জন্য চাঁদা হিসেবে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর জন্য ব্যয় করতে পারবেন। এই অর্থ সংগ্রহ করা হবে চলতি আয়কর আইনের একটি ‘লুপহোল’ বা ফাঁকফোকর বন্ধ করে। এই লুপহোল বন্ধ হলে বছরে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব। জিলিব্রান্ড এই অর্থের নাম দিয়েছেন ‘ডেমোক্রেসি ডলার’। আমেরিকার কোনো কোনো শহরে, যেমন সিয়াটলে, ভাউচারের মাধ্যমে এই অর্থ বণ্টনের কর্মসূচি ইতিমধ্যেই হাতে নেওয়া হয়েছে। 

সিনেটর জিলিব্রান্ড স্বপ্ন দেখছেন তিনি আমেরিকার রাজনীতিতে অর্থের নিয়ন্ত্রণ সীমিত করে আনবেন। সত্যি তা হবে কি না জানি না, কিন্তু এই নিয়ে কথা শুরু হয়েছে। এই দাবি যত তীব্র হবে, তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও তত উজ্জ্বল হবে। রাজনীতির ওপর অর্থের নিয়ন্ত্রণ ঠেকাতে বাংলাদেশে আমরাও এই রকম অথবা বিকল্প কিছু ভাবতে পারি। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হলে অর্থের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাজনীতির বিকল্প নেই। 

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি