মুরসি এবং রাজনৈতিক ইসলামের মৃত্যু

মুহাম্মাদ মুরসি
মুহাম্মাদ মুরসি

জেলখানায় মুরসির মৃত্যুর ঘটনা পাশ্চাত্যকে নাড়া দেয়নি। দেওয়ার কথাও তো ছিল না, বরং মুরসির আমলের ময়নাতদন্তের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে তাদের গণমাধ্যম। যারা ‘মুসলিম’ নাম ধারণ করে গণতান্ত্রিক দুনিয়ার রাজনৈতিক ময়দানে ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় ভাগ নিতে চায়, তাদের এক নিখাদ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টায় আপাতত পাশ্চাত্য সফল। তুরস্কের ‘সুলতান’ এরদোয়ান ও কাতারের আমির শেখ তামিম ছাড়া মুরসির সাফল্য কামনার মতো কেউ ছিলেন না আরব বিশ্বে। এই মতভিন্নতা শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিকও। আর এই মতভিন্নতাই মার্কিন-ইসরায়েলি বৃত্তকে সাহায্য দিয়েছে মুরসির উৎখাতে। যার পরিণতিতে আবার মিসরে অন্ততপক্ষে কয়েক দশকের সেনাশাসন দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা। আরব বিশ্বে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের প্রতি এই অকুণ্ঠ পাশ্চাত্য সমর্থন গণতন্ত্রমনাদের শুধুই হতাশাই বাড়ায়নি, পর্যুদস্ত করেছে মানসিকভাবেও।

মুরসির উৎখাতের বার্তার আরব বিশ্বের নেতাদের নীরবতাই ছিল গদি রক্ষার উপায়। তবে সেক্যুলারদের একটি অংশের নীরবতা সবাই অবাক করেছে। এরাই বহুকাল ধরে সেনাশাসনের বিরোধিতা করে এসেছে। যারা রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী, তারাও মুরসির শাসন আমলের পুঙ্খানুপুঙ্খ ময়নাতদন্ত করে মুরসিকে স্বৈরাচারী প্রমাণের কাজে ক্ষান্ত দেয়নি। তবে এর বাইরে দাঁড়িয়ে মিসরের রাজনৈতিক পরিক্রমাকে উল্টো দিক থেকে পড়ার আগ্রহও আরব বিশ্বে কম নয়। এই আগ্রহ নানা কারণেই, হোক তা অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক।

রাজনৈতিক মাঠে মুরসির আবির্ভাব ছিল দীর্ঘদিনের অনাচারের অবসানের প্রতীক হওয়া ‘আরব বসন্তের’ ফলাফল। এই ‘আরব বসন্তকে’ বসন্ত বলে আখ্যায়িত করতে নারাজের তালিকা অনেক দীর্ঘ। বিশ্বখ্যাত নৃবিজ্ঞানী টিমোথি মিচেল তাঁর ‘কার্বন ডেমোক্রেসি’ বইতে আরব বসন্তকে বসন্তের চরিত্র দিতে নারাজ। এককথায়, মিচেল আরব বসন্তকে তেল উৎপাদনের কঠিন সমীকরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। মিচেল প্রশ্ন তুলেছেন, বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব, কাতার, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাতে কেন আরব বসন্তের সুনামি জাগেনি।

মিচেলের যুক্তিতর্ক যেকোনো সচেতন আগ্রহী পাঠকের জন্য চিন্তার জোগান দেবে। ক্ষমতায় আসীন হয়ে মুরসিকে লড়তে হয়েছে ষাট বছরের সুসংগঠিত ও চক্রবদ্ধ রাষ্ট্রযন্ত্রের কোর্ট-কাচারির সঙ্গে। তারা নির্বাচিত সংসদকে বাতিল করে মুরসিকে হরণের যাত্রায় ছিল আরও বেশি সুসংগঠিত। আদালতের অখ্যাতিপূর্ণ এই আচরণের ইতি টানার পদক্ষেপে স্বৈরতন্ত্রের গন্ধ পান অনেকে। সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিনদের নতুন সহযোগী হয়ে ওঠেন কোনো কোনো সেক্যুলার, মধ্যমপন্থী আর নারীবাদীরা। এঁরা বিভিন্ন কারণে মুরসির প্রতি বিরাগভাজন হয়ে মুরসির পতনের আন্দোলনে শামিল হন। ফলাফল, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কারাগারে বিনা চিকিৎসায় মিসরের ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মৃত্যু এবং মিসরে আবার অশেষ সেনাশাসনের শুরু। এ কথা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না—কফিনে শুধু মুরসি একাই যাননি, নিয়ে গেছেন রাজনৈতিক ইসলামের ভবিষ্যৎ, সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকামীদের আগামীকেও।

মুরসির অমানবিক মৃত্যু আরবসহ দুনিয়ার কোথাও সাড়া জাগায়নি। তবে এই মৃত্যুতে টনক নড়েছে তুরস্কের সব শ্রেণির মানুষের। সেক্যুলারদেরও, রাজনৈতিক ও মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে যাঁরা মুরসির রাজনৈতিক মতাদর্শের বিশাল সমালোচক। বিশ্বাসীরা রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে মুরসিকে স্মরণ করেছেন সব মসজিদে। এমনকি এরদোয়ান নিজে ইস্তাম্বুলে হাজির থেকে প্রতীকী শবযাত্রার আনুষ্ঠানিকতাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন। বিক্ষোভ–প্রতিবাদ হয়েছে গণতন্ত্র পুনরুত্থানের স্বপ্নে।

কিন্তু যারা এরদোয়ানকে শর্ত সাপেক্ষে বা নিঃশর্তে গণতন্ত্রী মানে, পাশ্চাত্য কোনোভাবেই তাদের গণতন্ত্রী হতে দেবে না। আর সেক্যুলারদের কট্টর অংশ মুরসির মৃত্যুর মধ্যে এরদোয়ান পতনের দাগ দেখছে। তারা ভাবছে, মুরসির মৃত্যু রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণের পরিণতি। তাদের বিশ্বাস, রাজনৈতিক ইসলামের ভবিষ্যৎ নেই।

এরদোয়ান মুরসির পতন রোধে সোচ্চার ছিলেন শুরু থেকেই। মুরসিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হওয়ার আগে এরদোয়ানের দুইবারের মিসর যাত্রা ছিল মুরসি–সমর্থকদের টিকে থাকার শক্তি। আর বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর তুরস্কের জাতীয় গোয়েন্দা প্রধানকে বারবার পাঠিয়েছিলেন মুরসিকে সতর্ক করার জন্য, সেনা অভ্যুত্থান রুখে দেওয়ার জন্য। কোনো কিছুই নিয়তিকে বদলায়নি। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে ঠিক একই সময়ে ইস্তাম্বুলে এরদোয়ানবিরোধী গেজি পার্ক বিক্ষোভ শুরু হয়, যা পরবর্তী সময়ে তুরস্কে এরদোয়ানবিরোধী নতুন স্রোতের শুরু করেছিল। এরদোয়ানপন্থীরা এই বিক্ষোভকে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন। গেজি পার্ক বিক্ষোভকে এরদোয়ান কঠোর হস্তে দমন করেছিলেন। এটা তাঁকে একনায়কতন্ত্রের মর্যাদা দিয়েছিল ইউরোপর প্রতিটি রাজধানীতে।

পাশ্চাত্যনিবাসীদের প্রকাশ্য সমর্থনে ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনে সিসির পরাজয়ের কোনো লক্ষণ ছিল না। নির্বাচনে ৯৭ শতাংশ ভোটে জয়ের পর সিসি ইউরোপ ও আমেরিকার রাজধানীগুলোতে ঘুরে বেরিয়েছেন, এমনকি জাতিসংঘে ভাষণও দিয়েছেন শান্তি আর গণতন্ত্র নিয়ে। কেউ কেউ মিসরের মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে আওয়াজ তুললেও তা ইউরোপের সীমানার বাইরে যায়নি, বরং সিসির শাসনকে বৈধ বানিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষ্যে ৬০ হাজার রাজনৈতিক কয়েদি সিসির অন্ধকার কারাগারে।

মুরসির ক্ষণিকের শাসনের বিশ্লেষণে ডান, বাম, উদার ও কট্টর—সব দিক থেকে অনেকে এককাট্টা হয়েছে মুরসিকে স্বৈরাচারীর তালিকাভুক্ত করার আয়োজনে। সঙ্গে পেয়েছে পাশ্চাত্য গণমাধ্যম ও একাডেমিক দুনিয়াকে। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন শর্তে মুরসি নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে ইতি ঘটবে তাঁর আমলের। এটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ তা হতে দেয়নি। সৌদি-মার্কিনদের প্রধান লক্ষ্য, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নির্ধারণ করা। সে নিরাপত্তা নির্ধারণে কেউ হন গণতন্ত্রকামী ও সংস্কারকামী। আর কেউ জেলখানায় জীবনের ইতি টানেন স্বৈরাচারের অভিযোগের তকমা লাগিয়ে।

রাহুল আনজুম; তুরস্কে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি।