আওয়ামী লীগের যোগ-বিয়োগ

১ জুলাই থেকে সারা দেশে নতুন করে আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। এর আগে দলের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘তারুণ্যের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’ নীতির আলোকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শভিত্তিক আগামী প্রজন্ম গঠন এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে তরুণসমাজকে উন্নয়নমুখী কল্যাণকর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার জন্যই সাংগঠনিক এ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সদস্য সংগ্রহের কাজ শুরু না হতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক ওঠে। ৩০ জুন তাঁর কাছে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধী পরিবারের কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের সদস্য হতে পারবেন কি না। জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘...ওই পরিবারের...কেউ হয়তো...সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে ছিল বা জামায়াতে ইসলামী করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যার যোগসূত্র ছিল, তো সেটা ৪৭ বছর পরে এ ধরনের বিষয়টি দেখার তো কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা যাদের সদস্য করব, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডটাই মূলত...সে আসলে কী।’

তাঁর এই কথায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে ওবায়দুল কাদেরকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছে। অন্যথায় তারা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে কঠোর কর্মসূচি নেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু যখন বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছিলেন, তখন এ রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। 

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৫-এর(১) ধারায় বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিশ্বাস করে নির্ধারিত ফরমে প্রদত্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে ত্রিবার্ষিক ২০ টাকা চাঁদা প্রদান করে ১৮ বছরের বেশি বয়সী বাংলাদেশি নারী-পুরুষ সদস্য হতে পারবেন। 

ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় সম্প্রতি একটি ব্যানার চোখে পড়েছে, ‘দাঁড় কাউয়ামুক্ত মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগ চাই’। এর অর্থ অনেক কাউয়া আওয়ামী লীগে ঢুকে গেছে। বছর দুই আগে দলের সাধারণ সম্পাদকই কাউয়া সম্পর্কে নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মোহাম্মদপুরে টানানো একটি ব্যানার দেখে মনে হয়, সেই সতর্কবার্তা কোনো কাজে লাগেনি। আওয়ামী লীগে এখন দুটি শব্দ বেশ আলোচিত। কাউয়া ও হাইব্রিড। 

গত বৃহস্পতিবার বরিশালে বিভাগীয় প্রতিনিধি সমাবেশে তৃণমূলের নেতারা বলেছেন, ‘দলে অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাভোগী হাইব্রিড (উচ্চ ফলনশীল) নেতাদের কাছে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এই বসন্তের কোকিলদের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব পরিশ্রম, অর্জন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। তাদের দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে।’ (প্রথম আলো, ৫ জুলাই ২০১৯)

কালের কণ্ঠ–এর খবরে বলা হয়, আওয়ামী লীগের বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড; যে নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে বরগুনায় প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।...সভার প্রধান বক্তা তোফায়েল আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নয়ন বন্ড এক দিনে তৈরি হয়নি। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে নয়ন বন্ডরা তৈরি হতে পারে না। (কালের কণ্ঠ, ৫ জুলাই ২০১৯)। কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী অন্তত চারজন নেতা নয়ন বন্ডের আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারী সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ ধীরেন্দ্র দেবনাথ প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত থাকলেও কোনো কথা বলেননি। সাংসদপুত্র সুনাম দেবনাথের সঙ্গে নয়ন বন্ডের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে বরগুনা আওয়ামী লীগের একাংশ দাবি করেছে। 

রিফাত হত্যার মূল আসামি সাব্বির আহম্মেদ নয়ন বন্ড এখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, যদিও কয়েক দিন আগে তিনি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। তাঁর বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার রিফাত হত্যা মামলার অগ্রগতিবিষয়ক শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘নয়ন বন্ডরা এক দিনে তৈরি হয় না। একা একা তৈরি হয় না। কেউ না কেউ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।’ আওয়ামী লীগের নেতারাও স্বীকার করেছেন, নয়ন বন্ডদের অপকর্মই সরকারের সব অর্জন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে, সমাজে চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। কিন্তু তাঁরা কেউ কাউয়া ও হাইব্রিডদের দলে আসা বন্ধ করছেন না। 

বরগুনায় নয়ন বন্ডকে কে বা কারা তৈরি করেছে, সেটি তিনিই ভালো বলতে পারতেন। এমনকি তাঁর জবানবন্দি থেকে রিফাত হত্যার বিচারে নয়ন বন্ডদের পেছনে কারা ছিল, সেটিও বেরিয়ে আসতে পারত। কিন্তু সেই সুযোগ আর এখন নেই। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, যারা নয়ন বন্ডদের তৈরি করে, তারা নিজেদের আড়াল করতেই কি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটায়? যে পুলিশ বাহিনী দুর্ধর্ষ জঙ্গিকেও জীবিত আটক করতে পারে, সেই পুলিশ বাহিনী কেন নয়ন বন্ডের মতো এক মাঝারি মাপের সন্ত্রাসীকে জীবিত ধরতে পারল না? গত দুই বছরে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানে কয়েক শ মানুষ বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। কিন্তু তাতে মাদক ব্যবসা কিংবা এর ব্যবহার কমেনি।

বরগুনার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে যেসব তথ্য জানা গেল, তা আরও উদ্বেগজনক। তাঁদের মতে, রিফাত হত্যার কারণ শুধু আয়েশা সিদ্দিকা নামের মেয়েটির সঙ্গে তাঁর বিয়ে নয়। নয়ন বন্ড ও তাঁর সহযোগীরা শঙ্কায় ছিলেন তাঁদের মাদক সাম্রাজ্য হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। একসময় রিফাত শরীফ নয়ন বন্ডের সঙ্গে থাকলেও পরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সঙ্গে হাত মেলান। শুধু বরগুনা নয়, সারা দেশেই অদৃশ্য গডফাদারদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মাঠপর্যায়ের সন্ত্রাসীরা বেড়ে ওঠে এবং মারাও পড়ে। কিন্তু গডফাদাররা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরেই। 

বরগুনায় রিফাত হত্যার ঘটনার পরপরই চট্টগ্রামে যুবলীগের কর্মী মো. মহসিনকে (২৬) পিটিয়ে গুরুতর আহত করার ঘটনা ঘটে এবং ফেসবুকে সেই দৃশ্যও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যুবলীগ কর্মী মহসিনকে যাঁরা পিটিয়েছেন, তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের কেউ নন, তাঁরা সবাই যুবলীগের কর্মী। ঘটনার আগের দিন তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান। তিনি নগরের উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার মোর্শেদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এ ঘটনায় মো. সাজু, মো. তারেক, বেলাল হোসেন, মো. মিরাজ ও মো. মাসুদ নামের পাঁচজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তাঁরা সবাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জহুরুল আলম জসীমের অনুসারী। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এক আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারীরা অন্য আওয়ামী লীগ নেতার অনুসারীকে রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে পিটিয়েছেন, তাঁকে রক্তাক্ত  করেছেন। পরে হামলাকারীরা মৃত ভেবে তাঁকে রেখে চলে যান। আইন-আদালত-পুলিশকে তঁারা থোড়াই তোয়াক্কা করেন। 

দেশে এখন বিরোধী দলের কোনো তৎপরতা নেই। কোনো আন্দোলন নেই। কিন্তু সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে রানীতিকে চাঙা রাখার চেষ্টা করছেন। শিক্ষাঙ্গন কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গন যেখানে মারামারি আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগ বনাম ছাত্রলীগ। অন্য কেউ মাঠে নেই। 

বরগুনার ঘটনা বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘যদি কারও দলীয় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়, অবশ্যই তাঁকে বিচারের আওতায় আনা হবে।’ এত কিছু ঘটার পর আর কী প্রমাণ দিতে হবে? আদালত তো বলেই দিয়েছেন, নয়ন বন্ডরা একা একা তৈরি হয় না। জেলা আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই গ্রুপ যে একে অপরকে দায়ী করছে, সেটাও একধরনের প্রমাণ। বন্দুকযুদ্ধে নয়ন বন্ড নিহত হয়েছেন। কিন্তু যাঁরা রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীস্বার্থে
তাঁকে তৈরি করেছিলেন, তাঁদের বিষয়েও দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ক্ষমতা বাড়াতে সদস্য সংগ্রহ করছে। নতুন প্রজন্মের কর্মীদের দলে টানতে চাইছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই যোগের আগে কাউয়া ও হাইব্রিড নেতা-কর্মীদের বিয়োগ করার কথা কি আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতারা একবারও ভাবছেন? 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি