নারী হওয়া কেন ব্যয়বহুল?

১০ শতাংশের কম নারী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। ৮৬ শতাংশ নারী মাসিকের সময় ব্যবহার করেন অস্বাস্থ্যকর উপকরণ।
১০ শতাংশের কম নারী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। ৮৬ শতাংশ নারী মাসিকের সময় ব্যবহার করেন অস্বাস্থ্যকর উপকরণ।

ঋতুস্রাবে পুরোনো কাপড়, তুলা, টিস্যু, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ট্যাম্পন, মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারের সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। গ্রাম-শহরের নারীরা মোটামুটি এসব পদ্ধতির বাইরে নন। কিন্তু চরফ্যাশন, চরকুকরি–মুকরি বা হাতিয়ার বিচ্ছিন্ন নিরিবিলি-নির্জন, সভ্যতাবিবর্জিত জনপদে পুরোনো কাপড়ে মুঠো মুঠো বালু গিঁট দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী রক্ত শোষণের সমাধানের কথা জানেন তো? শহুরে বাস্তবতায় হরেক রকম স্যানিটারি ন্যাপকিনের মনভোলানো বিজ্ঞাপন, নারীস্বাস্থ্য নিয়ে অসংবেদনশীল সুপারফিশিয়াল লেখাজোকার সমান্তরালে নোংরা কাপড়ে প্যাঁচানো বালুর বাস্তবতাও কিন্তু সত্য। কোনো কিছু না জানলেই তাই তা মিথ্যা হয়ে যায় না। ঋতুস্রাব নিয়ে কথা বলার আবেদন তাই এখনো এড়িয়ে যাওয়ার বাস্তবতায় এসে উপনীত হয়নি।

দেশে তৃণমূল পর্যায়ে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় পরিচালিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং ও প্রশিক্ষণ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর নতুনভাবে ১১ হাজার ৯৫৬ নারী জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং ৬ হাজার ৫৮২ জন মৃত্যুবরণ করেন।

এসব মৃত্যুর বাইরে ‘প্ল্যানেট ফিফটি-ফিফটি চ্যাম্পিয়ন’ অ্যাওয়ার্ড আর নারীর ক্ষমতায়নের ওপর বড় বড় দাবির তলায় পড়ে থাকে যে উন্নয়নের রোল মডেল বনে যাওয়া রাষ্ট্রে ১০ শতাংশের কম নারী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। ঢাকা পড়ে যায় শতকরা ৮৬ ভাগ নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাডের পরিবর্তে পুরোনো কাপড়, তুলো বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করেন। সেসব উপকরণ লোকচক্ষুর যত আলোকবর্ষ দূরে, গহিন অন্ধকারে, সূর্যের আলো পৌঁছায় না, সেখানে শুকাতে দেওয়া হয়।

নারীর সালোয়ার-কামিজ, অন্তর্বাস ধুয়ে প্রকাশ্যে রোদে শুকাতে দেওয়ার বিরুদ্ধে যে সমাজে সামাজিক জনমত তৈরি করা হয়, রাষ্ট্র নিজের স্বার্থ নেই বলে যে জনমতের ওপর হস্তক্ষেপ করে না; বরং নারীস্বাস্থ্য ও প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর কোনো রকম নজরদারি না করে নারীবিদ্বেষী আচরণে ‘মৌনব্রত’ পালন করে। এমন দেশে নারী ঋতুস্রাবের কাপড়চোপড় প্রকাশ্যে শুকাতে দেবেন—এটা প্রত্যাশা করাও উচিত নয়।

যে দেশের অফিস–আদালতে ঋতুস্রাবের বেদনা ঢাকতে মাথাব্যথা, জ্বর, মা অসুস্থ ইত্যাদি অজুহাতে ছুটি চাইতে হয়, সে দেশে ঋতুস্রাব নিয়ে প্রচুর কথা বলতে হবে। প্রচুর কথা বলতে হবে স্যানিটারি প্যাড নিয়ে, স্যানিটারি প্যাডের মূল্য নিয়ে, স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহার নিয়ে, স্যানিটারি প্যাডের ওপর ধার্যকৃত কর নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোপের মুখে পড়ে আপাতত স্যানিটারি ন্যাপকিনের কাঁচামাল আমদানির ওপর থেকে আরোপিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাতে কী হয়েছে? গত বছরের ১৫ শতাংশ ভ্যাটই বহাল থাকছে তাই তো?

কিন্তু প্রতিবাদ করে কমনসেন্স তৈরি করা কি আদৌ সম্ভব? রাষ্ট্র ঋণখেলাপিদের ‘ভালো মানুষ’ প্রমাণ করতে, মন্ত্রী-এমপিদের হাতে দারিদ্র্য দূর করতে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে, কালোটাকা সাদা করতে, সুইস ব্যাংকের রিজার্ভ ভারী করতে, কোটি টাকার গাড়ির আমদানি শুল্ক ফ্রি করে দিতে পারে, কিন্তু দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সামান্য ভর্তুকি দিতে পারে না। বরং নারীকে নারী হওয়ার কারণে খেসারত দিতে হচ্ছে। দিনকে দিন নারীর জীবন ব্যয়বহুল করে তুলছে স্বয়ং রাষ্ট্র।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্যানিটারি ন্যাপকিন সাধারণত ছয় ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করলে তা স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। ঋতুকাল একেকজনের একেক রকম (চার থেকে সাত দিন)। বাজারে ১১০ টাকার যে প্যাডের প্যাকেট পাওয়া যায়, তাতে সাধারণত আটটি প্যাড থাকে। ধরে নিচ্ছি যে নারীর ৯৬ ঘণ্টা রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তার ছয় ঘণ্টা অন্তর প্যাড পরিবর্তন করলে সর্বমোট ১৬টি প্যাড লাগে। যার এই সময় সাত দিন তার লাগে ২৮টি। অর্থাৎ শুধু পিরিয়ড চলাকালেই পিরিয়ডের মূল্য হিসেবে একজন নারীকে পরিশোধ করতে হচ্ছে সর্বনিম্ন ২২০ থেকে ৩৮৫ টাকা।

বেশি দূর যেতে হবে না। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৮ থেকে ১০ টাকায় এক প্যাকেট স্যানিটারি প্যাড পাওয়া যায়। এমনকি বিভিন্ন স্থানে বিনা মূল্যেও তা নারীদের জন্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি হ্যান্ডমেড প্যাডের বাজারজাতকরণের ফলে গ্রামীণ নারীদের স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগও তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় একজন নারী প্রধানমন্ত্রী, নারী মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী থাকার পরেও এখানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো বিকল্পহীন মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন কিটের আমদানির ওপর ৪০ শতাংশ ভ্যাট ও ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়। এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেও অফলাইন ও অনলাইনেও রাষ্ট্রের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা নারীবিদ্বেষীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয়।

নারী হওয়াটা একজন নারীর চয়েস না হওয়ার পরেও নারীকে তাঁর নারীত্বের চরম মূল্য দিতে হয় প্রতিনিয়ত। চাকরিতে পুরুষের তুলনায় কম বেতন, দক্ষতার অবমূল্যায়ন, কর্মক্ষেত্রে কাজের অধিক প্রমাণ, ঘরে বিরতিহীন গেরস্থালির সব কাজ এক হাতে সামলানো, ঋতুচক্রের জটিলতাসহ গর্ভধারণপূর্ব ও পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও শারীরিক গঠনের উচ্চমূল্য না দিয়ে উপায়ান্তর নেই। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র চাইলে এই বোঝা কমাতে পারে, সেখানে নারীকে নারী হওয়ার কারণে অকারণ শাস্তি দেওয়া না হোক। নারীকে তাঁর নারীত্বের সবকিছু নিয়ে সহজ থাকতে দেওয়া হোক। নারীকে যেন ভাবতে না হয়, নারী হওয়াটা আসলে ব্যয়বহুল।

বীথি সপ্তর্ষি: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]