গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অরণ্যে রোদন

রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন বিষয়ে সময় সময় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সরকারের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অসাংবিধানিক সরকারের কথা আলাদা, কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে জনগণের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যে সিদ্ধান্তে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তারা উপকৃত হবেন, একটি বিশেষ গোত্র লাভবান হবে; অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ, সে সিদ্ধান্তে সরকারের বিশেষ লাভ নেই, কিন্তু সরকারি দলের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।

কোনো জিনিসের দাম চিরকাল একই রকম থাকবে—এ কথা নিতান্ত নির্বোধ ছাড়া কেউই বলবে না। আবার একই সঙ্গে এ কথাও ঠিক যে কোনো পণ্যের দাম শুধু বাড়বেই, কোনো দিনই কমবে না, তা নয়। উৎপাদন, বিপণন ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের দাম ওঠা-নামা করে। পণ্যের মূল্য নির্ধারণে যদি যৌক্তিকতা ও নৈতিক ভিত্তি না থাকে, তা হলে তা অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে। রাষ্ট্রের দিক থেকে যেকোনো অযৌক্তিক ও অন্যান্য সিদ্ধান্ত মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আবাসিক ও বাণিজ্যিকসহ সব ধরনের গ্যাসের দাম ১ জুলাই থেকে বাড়িয়েছে। যাঁরা এক চুলার জন্য এত দিন ৭৫০ টাকা দিতেন, এখন দিতে হবে ৯২৫ টাকা। ভোক্তার খরচ বাড়ল ১৭৫ টাকা। দুই চুলা যাঁদের তাঁদের দিতে হবে ৯৭৫ টাকা। আগে তাঁরা দিতেন ৮০০ টাকা। গড়ে গ্যাসের দাম বেড়েছে ৩২ দশমিক ৮০ শতাংশ। বাসাবাড়ির পাশাপাশি যানবাহনে ব্যবহার করা সিএনজি গ্যাসের দামও বেড়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৩ টাকা। যাঁরা এত দিন ৪০ টাকা দিয়ে কিনেছেন, এখন তাঁরা কিনবেন ৪৩ টাকা দিয়ে।

রান্নাঘরের চুলাওয়ালাদের এই যে মাসে ১৭৫ টাকা বেশি দিতে হবে, বিত্তবান বাংলাদেশে এখন এটা কোনো টাকাই না। বাংলাদেশে এখন এমন মানুষের সংখ্যা বহু, যাদের প্রতিদিনের রোজগার কোটি টাকার ওপরে। চুলাপ্রতি গ্যাসের দাম ১০ হাজার টাকা হলেই–বা তাদের কী যায় আসে!

সরকারি লোকেরা বলবেন, মাসে মাত্র এক–দু শ টাকা বেশি দিতে হবে, তা নিয়ে কেন এত কথা! একজন নিম্নমধ্যবিত্তও তো ধূমপান করে, পান খেয়ে, মোবাইল ফোনে কথা বলে কত টাকা উড়িয়ে দেন। তাঁরা জেনেও বলেন না, ওই ১৭৫ টাকা কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কী পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এটাও ঠিক, গ্যাসের দাম বাড়ালে আকাশ ভেঙে পড়বে না। জীবনযাত্রা থেমে থাকবে না। দাম বাড়ানোর আগে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জীবন যেমন চলেছে, তেমনই চলবে। বাইরে থেকে কোনো পরিবর্তনই চোখে পড়বে না। পোশাক কারখানায় কাজ করে পারুল আখতার। সারা মাসই বাসে যাওয়া–আসা করত। এখন থেকে সে মাসে পাঁচ-সাত দিন ৪ কিলোমিটার হেঁটে ঘরে ফিরবে। পারুলের ঘরওয়ালার যে চুলায় রাত জেগে চারজন পালা করে রান্না করে, আগে তাদের দিতে হতো ৪০০ টাকা, এখন থেকে দেবে ৫০০ টাকা। গাড়িভাড়া আগে দিত ১০ + ১০ কুড়ি টাকা, এখন দিতে হবে ১৫ + ১৫ মোট ৩০ টাকা। মা ও বুড়ি নানিকে আগে পাঠাত ১,২০০ টাকা, এখন দেবে ১,০০০ টাকা।

লিটনুজ্জামান মিয়া কলেজে পড়ে। টিউশনি করে। থাকে মেসে। তার সিট ভাড়া, খাওয়া ও বাসভাড়া, সবসুদ্ধ খরচ বেড়েছে ১,১০০ টাকা। যে পরিবারে সদস্য পাঁচজন। দেড় কামরা ভাড়া নিয়ে তারা ঢাকায় থাকে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে স্কুল-কলেজে পড়ে। তাদের খরচ বাড়বে ৩,২০০ টাকা।

গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে বিইআরসি ‘গণশুনানি’ করেছিল। নিজেদের সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে অটল থেকে একধরনের তথাকথিত শুনানি করা পরিহাসের মতো। শুনানিতে যাঁরা যান তাঁদের দিনটিই নষ্ট হয়। আমিও দু–একবার গেছি। কর্মকর্তাদের ব্যবহার খুবই সৌজন্যমূলক। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না। তাই বিইআরসি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। ভোক্তাবন্ধন হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। প্রেসক্লাবে গোলটেবিল হয়েছে। ব্যবসায়ী নেতারাও দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ করেছেন। ক্যাবের পক্ষ থেকে আমাদের মতো কেউ কেউ উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিতেও গেছেন। পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে ব্যাপক লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ওদিকে কুম্ভকর্ণ, তাঁদের কানে কিছুই পশে না।

যেসব দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্ট রয়েছে, বহুদলীয় গণতন্ত্র রয়েছে, সেখানে এ–জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এমপিরা পার্লামেন্ট উত্তাল করে তোলেন। সরকারি দলের সদস্যরাও কখনো জনস্বার্থে সরকারের অনেক কাজের বিরোধিতা করেন।

সরকারি দলের সদস্য হওয়া মানেই দাসখত দেওয়া নয়। নিজের বিবেক ও ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া নয়। তা যে নয় তা আমাদের দেশেও আমরা দেখেছি পঞ্চাশের দশকে। ১৯৫৬-৫৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ সরকার। বাইরে সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতারা অনেক ব্যাপারে মন্ত্রীদের ও সরকারের কাজের সমালোচনা করেছেন। আতাউর রহমান বলেছেন, আমার অবস্থা বিব্রতকর, কিন্তু দলের নেতাদের মুখ তো বন্ধ করতে পারি না। অবশ্য সেটা ছিল গণতান্ত্রিক সরকার।

যেকোনো পণ্যের দাম নির্ধারণের একটি পদ্ধতি রয়েছে। যখন কোনো পক্ষ যুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদের খোঁড়া যুক্তির অভাব হয় না। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রেও তা–ই। সরকারের যুক্তি এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানির কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রয়োজন হবে ১৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। ভোক্তাদের থেকে আদায় না করলে সরকার এই টাকা পাবে কোথায়?

আমাদের মতো ভোক্তাদের কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা হিসাব করে দেখিয়েছি, দাম বাড়ানোর দরকার নেই। হতে পারে ভোক্তাদের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অঙ্কে কাঁচা। তাঁদের যোগ-বিয়োগ ভুল হতেই পারে। জ্বালানি বিভাগের কর্তারা তো পাটিগণিতে পাকা। তাঁরা দেখিয়েছেন গ্যাসের দাম না বাড়ালে সরকারের সর্বনাশ হবে, এমনকি ভর্তুকি দিয়ে ফতুর পর্যন্ত হতে পারে। সে জন্যই ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাব আদালতে গেছে।

আমরা প্রার্থনা করেছি সরকারের জমা-খরচের খেরোখাতাটা ভোক্তাদের দেখিয়ে দিন। মাননীয় আদালতও সেই রকম কথাই বলেছেন। শুনানির দিন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম এবং আমি আদালতে উপস্থিত ছিলাম। আমাদের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার যুক্তির সমর্থনে মাননীয় বিচারপতিও বলেছেন, গ্যাস খাতের দুর্নীতি অর্ধেক কমলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। জ্বালানি বিভাগে দুর্নীতি কমাতে পদক্ষেপ না নেওয়ায় আদালত দুদকেরও সমালোচনা করেন। আদালত সংশ্লিষ্ট বিভাগের আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে বলেছেন।

ভারত আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কেনে প্রতি ইউনিট ৬ ডলারে, বাংলাদেশ কেনে ১০ ডলারে। ব্যাপারটা যেন মনে হয় এ রকম: আমরা যে দোকান থেকে গ্যাস কিনি তা ভারতের কেনা গ্যাসের চেয়ে ৪০ ভাগ বেশি ভালো এবং তাতে আগুনের তাপ দেড় গুণ বেশি। ভারতে যতটুকু গ্যাস দিয়ে একজন এক হাঁড়ি ভাত রান্না করবে, আমাদের গ্যাস দিয়ে ভাত পাকানো যাবে পৌনে দুই হাঁড়ি। এলএনজি আমদানিতে একশ্রেণির রাজনীতিক, কর্মকর্তা ও সরকারি আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীরা লালে লাল হয়ে যাবেন। কষ্ট নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের।

সরকারের কোনো সিদ্ধান্তই ঐশী নির্দেশ নয়, তা পরিবর্তনসাপেক্ষ। জনগণের আবেগ ও দাবিকে সরকার উপেক্ষা করতে পারে না। গ্যাসের দাম বাড়ালে সরকারের ওপর জনগণ অসন্তুষ্ট হবে। জন–অসন্তোষ সৃষ্টি করার পরিণাম শুভ হয় না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক