বাংলাদেশের 'চীনা তাস'

দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর শেখ হাসিনা তাঁর মন্ত্রিসভায় একজন স্বল্পপরিচিত চীনাপন্থী রাজনীতিককে মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ঘটনাটায় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। পরে জেনেছিলাম তিনি হলেন এই মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের ‘চীনা তাস’। ভারতের পাশাপাশি চীনের সঙ্গেও একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক চান প্রধানমন্ত্রী। চীনের সঙ্গে তেমন ভারসাম্য অর্জনে এই রাজনীতিক হয়তো কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন, এমন অঙ্ক নিশ্চয় তিনি করে থাকবেন। 

এরপর এক দশক কেটে গেছে। এই সময়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিকটতর হয়েছে। কেউ কেউ বলবেন অর্থনীতিতে ভারতের প্রভাব এখন অনস্বীকার্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও মানতে হবে মাঠে একা ভারত নেই, চীনও রয়েছে। সেও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ক্রমেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই ভারসাম্য অর্জনে সেই মন্ত্রীর কোনো ভূমিকা আছে বলে শুনিনি, তবে প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে বড় ভূমিকা নিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

এই অঞ্চলে ভারত ও চীন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। একাত্তরে তার ভূমিকার কারণে ভারত আশা করে বাংলাদেশের ওপর তার অতিরিক্ত দাবি রয়েছে। তাকে ডিঙিয়ে বাংলাদেশ হাত বাড়াবে চীনের দিকে, যে চীন একাত্তরে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, এটি ভারতের পছন্দ হওয়ার কথা নয়। চীন-বাংলাদেশ মাখামাখিতে ভারতের অন্য ভয়ও রয়েছে। চীন ও ভারত গত অর্ধ শতকে একাধিকবার যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধ আবারও হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে চীন ভারতের পূর্বাঞ্চলে সামরিক ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে। পাকিস্তান আমলে নাগা বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের মাটিতেই প্রশিক্ষণ দিত চীন, সে কথা তার নিশ্চয় মনে আছে। 

চীন ক্রমেই বাংলাদেশের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে, সম্প্রতি দুটি সাবমেরিন সে কিনেছে চীনের কাছ থেকে। সেটাও ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ। 

তা সত্ত্বেও যে দক্ষতায় বাংলাদেশ তার অতিকায় দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, তাতে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরাও বাহবা না দিয়ে পারেননি। তাঁরা বলেছেন এই ‘ব্যালেন্সিং অ্যাক্টের’ সব কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী হাসিনার। ভারতের থিংক ট্যাংক গেটওয়ে হাউসের সম্মানিত ফেলো রাজীব ভাটিয়া মন্তব্য করেছেন, একদিকে ভারত সরকারের সঙ্গে আস্থা ও সখ্য নির্মাণ, অন্যদিকে চীন থেকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগিতা আদায়, এই দুই বিপরীতমুখী রণকৌশল বাস্তবায়নে হাসিনা ‘যথেষ্ট দক্ষতা ও সাফল্য’ দেখাতে পেরেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি চীন ঘুরে এসেছেন। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চীন অনেক দিন থেকেই আমাদের প্রধান অংশীদার। দেশটি থেকে আমরা বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকি। এ ব্যাপারে ভারত পিছিয়ে, সেখান থেকে আমাদের আমদানির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারেরও কম। তবে এই দুই দেশে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় সমান। চীন ও ভারত দুই দেশই আমাদের অবকাঠামো খাতে বড় রকমের ভূমিকা রাখছে। তবে ভারতের নিজের ক্ষমতা সীমিত, চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য তার নেই। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ ইতিমধ্যেই ভারতকে কয়েক গুণ ছাপিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর এই দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীরতর হবে, সেটাই স্বাভাবিক। 

তবে সেটি ভালো না মন্দ, তা নিয়ে কোনো কোনো মহলে সন্দেহ রয়েছে। সেতু, মহাসড়ক, টানেল ইত্যাদি নির্মাণ বাবদ চীন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান ঋণ প্রদানকারী দেশ হয়ে উঠেছে। আমরা এখন চীনের বিখ্যাত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই প্রকল্পের অধীনে পৃথিবীর মোট ১৫২টি দেশের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রপথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন দেদার অর্থ ঢালছে। আমরাও তাদের সে খোলা হাত নীতির সুবিধাভোগী। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর যে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সাহায্যের চুক্তি হয়েছিল, সে অঙ্ক ধরে বাংলাদেশে চীনের মোট ঋণের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আজ হোক বা কাল, এই অর্থ বাংলাদেশকে ফেরত দিতে হবে। ব্যর্থ হলে গলায় ঋণের যে ফাঁস লাগবে, তা ছাড়ানো খুব সহজ হবে না। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা তো আমাদের সে কথাই বলে। 

শ্রীলঙ্কার কথাই ধরুন। চীনা অর্থে ও কারিগরি সহায়তায় সে দেশের হাম্বানটোটা বন্দর নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু তার নির্মাণ খরচ বাড়তে বাড়তে এমন এক অবস্থায় দাঁড়ায় যে ঋণের সুদ গুনতেই শ্রীলঙ্কার প্রাণ যাওয়ার জোগাড়। ভাবা হয়েছিল এই বন্দর থেকে বিস্তর আয় হবে, অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল খুব সামান্যসংখ্যক বাণিজ্যিক জাহাজই এই বন্দরে এসে ভিড়ছে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই শ্রীলঙ্কা ১৫,০০০ একর জায়গাসহ সেই বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে ইজারা দিতে বাধ্য হয়। 

ঋণ নিয়ে তা শোধ করার এই ব্যর্থতাকে অর্থনীতিবিদেরা নাম দিয়েছেন ‘ঋণের ফাঁদ’। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকসমূহ অনেক দিন থেকেই গরিব দেশকে সাহায্য করার নামে এই ঋণের ফাঁদ পেতে রেখেছে। এখন ‘গরিবের বন্ধু’ চীনও সেই পথ ধরেছে। আফ্রিকার অনেক দেশই এখন এই ফাঁদে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। একই অবস্থা মালদ্বীপ ও ফিলিপাইনের। ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীনা ঋণ মাথায় নিয়ে পাকিস্তানও এখন নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ছে। এক সরকারি হিসাবে বলা হয়েছে, জ্বালানি খাতে চীনের বিনিয়োগকৃত ২৬ বিলিয়ন ডলারের জন্য আগামী ২০ বছরে পাকিস্তানকে ৪০ বিলিয়ন ডলার গুনতে হবে। ঋণের ফাঁদই বটে! 

ভালো খবর হলো, এই ফাঁদের কথা বাংলাদেশ জানে। এপ্রিল মাসে বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরামে অংশ নিতে বেইজিং এসেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ঋণের দাবি বাংলাদেশ কখনোই তুলবে না। সাধ্যের বাইরে ঋণের বোঝা ঘাড়ে চাপলে বিপদ হবে, বাংলাদেশ এ কথা জানে। শাহরিয়ার আলম জানান, নিজের ক্ষমতাতেই বাংলাদেশ পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্পে হাত দিয়েছে। অন্যান্য দেশ ও ব্যক্তিগত খাতের সঙ্গে অংশীদারত্বের কথাও বাংলাদেশ ভাবছে। পত্রিকাটি বাংলাদেশের এই রণকৌশলকে চীনকে এড়িয়ে বিকল্প সূত্র থেকে সম্পদ আহরণের উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছে। 

স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, বাংলাদেশ যে চীন থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে চায়, তার আরেক বড় প্রমাণ বাংলাদেশের জলসীমায় চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে না পারা। মিয়ানমার থেকে আফ্রিকার জিবুতি পর্যন্ত ‘মোতির মালা’র মতো একের পর এক সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে চলেছে চীন। তার নিজের বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রয়োজনে বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও নোঙর করার জায়গা খুঁজছে। ভারতেরও একই লক্ষ্য। বাংলাদেশেরও একটা গভীর সমুদ্রবন্দর চাই। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অংশগ্রহণ প্রায় নিশ্চিত ছিল, কিন্তু ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। পটুয়াখালীর পায়রাতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে, তাতেও নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিল চীন। ভারতও চায় সেখানে পা রাখার মতো জায়গা। এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর রশি–টানাটানি এড়াতে বাংলাদেশ ঠিক করেছে শুধু এই দুই দেশ নয়, আরও ১০টির মতো দেশকে এই প্রকল্পে অংশগ্রহণে আমন্ত্রণ জানানো হবে। এর ফলে সাপও মরবে, বাংলাদেশের লাঠিও ভাঙবে না। 

সমুদ্রবন্দর হোক বা পদ্মা সেতু হোক, যা করবে বাংলাদেশ নিজের স্বার্থেই করবে। গত বছর নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের এই কথা বুঝিয়ে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। শুধু চীন বা ভারত নয়, পৃথিবীর সব বন্ধুভাবাপন্ন দেশ থেকেই সাহায্য-সহযোগিতা নিতে আগ্রহী বাংলাদেশ। ‘আমরা দেশের উন্নয়ন চাই। আমাদের জনগণের কথা চিন্তা করতে হবে। কেননা, তাঁরাই এসব উন্নয়নের সুবিধা ভোগ করবেন।’ 

ভারতের মাটিতে বসেই তাঁর ‘চীনা তাস’টি এভাবে খেললেন হাসিনা। 


হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি