নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে সরকার গৃহীত পদক্ষেপ কতটুকু যৌক্তিক?

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুতে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: আবদুস সালাম
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুতে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: আবদুস সালাম

এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ সড়কের দাবিতে দুটি আন্দোলন দেখেছে। তরুণ, মূলত শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এ আন্দোলনের দ্বিতীয় দফা ১৯ মার্চ হওয়ার পর কেটে গেছে প্রায় চার মাস। কেমন ছিল গত চার মাসের দুর্ঘটনার চিত্র? বেসরকারি সংস্থা নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন মাসে সড়কে ঝরেছে ১ হাজার ১১৭টি প্রাণ। এর মধ্যে এপ্রিলে সারা বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৩৪০ জন এবং আহত হয়েছে ৬১০ জন। মে মাসে নিহত হয়েছে ৩৩৮ জন ও আহত হয়েছে ৫০৪ জন এবং জুনে নিহত হয়েছে ৪৩৯ জন এবং আহত হয়েছে ৮১৮ জন। পরিসংখ্যানই বলে দেয়, সড়কের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি বিন্দুমাত্র।

গত ১৯ মার্চ রাজধানীর ভাটারা এলাকায় যমুনা ফিউচারের সামনে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নামেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। পরে প্রশাসনের দেওয়া ‘আশ্বাস বটিকায়’ বিশ্বাস করে রাস্তা ছাড়েন তাঁরা। এবার ‘শুধু আশ্বাস নয়, কাজও করা হবে’—এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে শিক্ষার্থী ও কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে নগর ভবনে আলোচনায় বসেন মেয়র। সেই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বিআরটিএ, বিআরটিসি, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও।

ওই বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগগুলো তুলে ধরা হয়, তার মধ্যে ৫৬টি পদচারী-সেতু ও আন্ডারপাস নির্মাণ, ৩১টি জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ, ৪২৬টি ট্রাফিক সাইন স্থাপন, বর্তমান পদচারী-সেতুগুলোয় এস্কেলেটর (যন্ত্রচালিত সিঁড়ি) স্থাপন ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য। এসব উদ্যোগই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর সরকারি আশ্বাসের ভিতটি তৈরি করেছে। কিন্তু এ উদ্যোগগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে কি আদৌ কোনো গবেষণা হয়েছে, নাকি স্রেফ ক্ষতের ওপর পট্টি লাগানোর কৌশলী ভূমিকা পালন করছে প্রকল্পগুলো? এই ব্যয়বহুল প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনই বা কতটুকু?

বর্তমানে ঢাকা শহরে পদচারী-সেতু রয়েছে ৪৩টি। ২০১৮ সালে চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের পদচারী-সেতুগুলোর কার্যকারিতা ৬০ শতাংশ। কিছু কিছু এলাকায়, যেমন ফার্মগেট মোড় ও বারডেম হাসপাতালের সামনের পদচারী-সেতুর কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ (মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য এগুলো আবার ভেঙে ফেলা হয়েছে)। কিন্তু গুলশান এলাকায় পদচারী-সেতুর কার্যকারিতা মাত্র ১৭ শতাংশ। তবে কার্যকারিতা বিচারে নিউমার্কেট এলাকার পদচারী-সেতু এগিয়ে। এখানকার পদচারী-সেতুর কার্যকারিতা ৫৪ শতাংশ।

ঢাকায় পদচারী-সেতু ব্যবহারের ক্ষেত্রে পথচারীদের মধ্যে অনীহা দেখা যায়। কেউ সময় বাঁচাতে, কেউ নিরাপত্তার অভাবে, কেউবা আবার শারীরিক কারণে পদচারী–সেতুর বদলে সড়কই ব্যবহার করেন পারাপারের সময়; ঝুঁকি নিয়ে হলেও। এই যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা—এর মূল কারণ হলো ব্যবহারকারীর সুবিধা মাথায় রেখে এই সেতুগুলোর নকশা করা হয়নি। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২৪ মিটার চওড়া একটা রাস্তা পার হতে পদচারী-সেতু ব্যবহার করতে গেলে পথচারীকে হাঁটতে হয় প্রায় ৩৫০ মিটার। এ থেকেই আমাদের পদচারী-সেতুগুলোর কার্যকারিতা বোঝা যায়।

পদচারী-সেতু ব্যবহার করা হয় সেসব এলাকায়, যেখানে গাড়ির গতিবেগ ঘণ্টায় গড়ে ২০-২৫ কিলোমিটার। এসব ক্ষেত্রে সেতুটি রাস্তার দুই পাশের কমিউনিটির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। কিন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় যানবাহনের গড় গতিবেগ ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার, যা ২০২৫ সাল নাগাদ ৫ কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে। কাজেই ঢাকা শহরের বর্তমান পরিস্থিতিতে পদচারী-সেতু উপযোগী নয়।

এ অবস্থায় পদচারী-সেতু তৈরি কতটুকু কাজে আসবে? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মত হলো, কোনো পদচারী-সেতুই কাজে আসবে না, যদি না তা ব্যবহারকারীর দরকার মাথায় রেখে নকশা করা না হয়। নাগরিককে পর্যাপ্ত সুবিধা না দিয়ে তার ওপর আইন প্রয়োগ জবরদস্তি। বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন পদচারী-সেতু ও আন্ডারপাসের সংখ্যা ৫২টি। এর বেশির ভাগই কাজে আসছে না নকশার ত্রুটির কারণে। ফলে আরও ৫৬টি পদচারী-সেতু ও আন্ডারপাস বানানোর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। এ প্রশ্নের মীমাংসা না করে যত্রতত্র পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীন পদচারী-সেতু ও আন্ডারপাস বানালে তা শুধু প্রকল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতিকেই বেগবান করবে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে না কিছুমাত্র।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাঁরা একজোট। ছবি: আবদুস সালাম
নিরাপদ সড়কের দাবিতে তাঁরা একজোট। ছবি: আবদুস সালাম

২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ হেঁটে গন্তব্যে যান। এর মধ্যে ৭৬ শতাংশ মানুষের গন্তব্য ৫ কিলোমিটারের মধ্যে। কিন্তু এই নগরে হাঁটার পরিবেশও নেই। দিন দিন সরু হচ্ছে ফুটপাত। যতটুকু আছে, তা–ও আবার পার্ক করা গাড়ি ও হকারদের দখলে থাকছে। রয়েছে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য।

এ শহরের যাবতীয় পরিকল্পনা করা হয়েছে ও হচ্ছে মূলত মোটরচালিত যানবাহনের কথা মাথায় রেখে। গড়ে ১২ ফুট রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চলতে পারে ঘণ্টায় ৪ হাজার, মানুষ চলতে পারে ১৯ হাজার, বাইসাইকেল চলতে পারে ১৪–১৫ হাজার। অনেক মানুষ হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছালেও সাইকেল দিন দিন জনপ্রিয় হলেও নগর-পরিকল্পনার সময় এখনো প্রাধান্য পাচ্ছে মোটরচালিত গাড়ি। নগর-পরিকল্পনায় এ ধরনের গৎবাঁধা প্রবণতা থেকে সরে আসাটা খুবই জরুরি।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ার ছিল সবচেয়ে যানজটপূর্ণ এলাকা। ওই এলাকায় অভাবনীয় পরিবর্তন আসে শুধু পথচারীদের চলাচলের সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়ায়। এই অভাবনীয় উদ্যোগ নেন নিউইয়র্ক নগরীর তৎকালীন ট্রাফিক কমিশনার জেনেট সাদিক খান। এসব বাস্তব উদাহরণকে নগর-পরিকল্পনায় কাজে লাগাতে হবে, যা একই সঙ্গে কার্যকর ও কম ব্যয়ের। এসব ছোট ছোট উদ্যোগ সফল হলে বদলে যেতে পারে ঢাকা শহরের চেহারা।

পদচারী-সেতুর চেয়ে জেব্রা ক্রসিংয়ের প্রাধান্য পাওয়া উচিত। তবে এটিও হতে হবে নাগরিকদের প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রেখে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নিউইয়র্কের ৬ অ্যাভিনিউর কথা। ওই সড়কের শেষ মাথায় জেব্রা ক্রসিং থাকলেও পথচারীরা তা ব্যবহার না করে মাঝামাঝি দিয়েই রাস্তা পার হতো। কারণ, তাদের গন্তব্য। পরে পরিকল্পনাবিদেরা অ্যাভিনিউর মধ্যেই জেব্রা ক্রসিং করে দেন। এতে মাত্র এক মাসে দুর্ঘটনার হার নেমে আসে।

রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে কিছু হলেই নাগরিকদের দোষারোপ করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। প্রায়ই অনেককে বলতে শোনা যায় ‘বাঙালির খাসলত খারাপ’। আসলে খাসলতের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ দিতে হবে পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীন ব্যবস্থাকে। মানুষ তার প্রয়োজন ও সুবিধাজনক পথই বেছে নেবে, যা নির্ঝঞ্ঝাট করার দায়িত্ব প্রশাসন তথা সরকারের। পথচারীদের পদচারী-সেতু ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য করা হয়। কখনো পাহারা বসিয়ে, কখনো রাস্তার মধ্যে উঁচু বিভাজক বসিয়ে এটি করা হয়। কিন্তু এতেও কাজ হয় না। নিউমার্কেটেই যেমন উঁচু সড়ক বিভাজক থাকা সত্ত্বেও মানুষ তা টপকে রাস্তা পার হতে আগ্রহী বেশি। সংলগ্ন পদচারী-সেতুতে থাকা অত্যধিক ভিড় ও হকারদের উপস্থিতির কারণেই এমনটা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জরুরি হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী ও কর্মজীবী নারী, শারীরিক প্রতিবন্ধী—অনেকের পক্ষেই সময়স্বল্পতা ও শারীরিক অক্ষমতার কারণে পদচারী-সেতু ব্যবহার সম্ভব হয় না। তাদের কথাও ভাবতে হবে।

সরকারি পরিকল্পনাতেও কিন্তু এমন নির্দেশনাই আছে। ২০০৫ সালে করা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে (এসটিপি) পথচারীকে সমতলে পারাপারের ব্যবস্থা করার কথা বলা আছে। কিন্তু তা না করে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে ‘অব্যর্থ বটিকা’ হিসেবে যেখানে-সেখানে খাড়া পদচারী-সেতু তৈরি করা হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে হকার কিংবা নেশাখোরদের আড্ডার স্থান; রয়েছে ছিনতাইকারীদের বিচরণ। ফলে নিরাপত্তাসহ নানা কারণে অকার্যকর পদচারী-সেতুগুলো মানুষ ব্যবহার করছে না। আর প্রশাসন দোষ চাপাচ্ছে মানুষের ‘খাসলতের’ ওপর।

এখন সময় এসেছে নাগরিকদের সচেতন হওয়ার। নাগরিকদেরই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জেনে তা আদায় করে নিতে হবে। নিজের অধিকার নিয়ে তাকে কথা বলতে হবে; প্রতিবাদ করতে হবে। অযথা পদচারী-সেতু নির্মাণ কিংবা বিদ্যমানগুলোয় এস্কেলেটর লাগিয়ে জনগণের মূল্যবান সম্পদ অপচয় না করে, সে অর্থ প্রশাসনের উচিত নিরাপদ সড়ক–সম্পর্কিত গবেষণা কিংবা জনসচেতনতামূলক প্রচারে ব্যয় করা। তা না হলে সড়কে নৈরাজ্য কখনো থামবে না।

তাহমীদ লাবিব: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস