জনসংখ্যা সমস্যা

উপমহাদেশের তিনটি জনবহুল দেশের (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) মধ্যে বাংলাদেশ যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক সফলতা দেখিয়েছে, সেটি প্রমাণ করতে গবেষণার প্রয়োজন হয় না। ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, তখন এর জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ কোটি। ৪৮ বছর পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা যখন সাড়ে ১৭ কোটি, পাকিস্তানের জনসংখ্যা তখন ২০ কোটি ৭০ লাখ। ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারী গড়ে ৬টির বেশি সন্তান জন্ম দিতেন। বর্তমানে এই হার জনমিতির জরিপ অনুযায়ী, ২ দশমিক ৩। স্বাধীনতার সময় ৮ শতাংশ দম্পতি আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করলেও এখন সেই হার ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের এই সাফল্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রশংসাও কুড়িয়েছে।

কিন্তু গত কয়েক বছরে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এই ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে যে বর্ধিত জনমিতির লভ্যাংশ পাওয়া যাবে এবং সে কারণে তাঁরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পালনে শৈথিল্য দেখিয়ে আসছেন। এটা যে কত বড় ভুল তা জমি, খাদ্য ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ওপর চাপই বড় প্রমাণ। দেশে প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও তার এক-তৃতীয়াংশকেও উপযুক্ত কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বর্ধিত জনবল জনমিতির লভ্যাংশ হয়ে ওঠা অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনা।

এসব কারণে ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ স্লোগানটি বেছে নেওয়া হয়েছিল। এরপর সরকার বদল হয়েছে। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারও স্লোগানটি আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু গত বছর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এই স্লোগান বাদ দিয়ে আশির দশকের ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ স্লোগানটিই ফিরিয়ে আনে। সরকারের জনসংখ্যা নীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার যে একই জায়গায় থমকে আছে। এর কারণ ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী মায়েদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।

জাতীয় জনসংখ্যা নীতিতে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিস্থাপনযোগ্য জনউর্বরতা অর্জন এবং আধুনিক জন্মগ্রহণ পদ্ধতি গ্রহীতার হার ৭২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়নি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কথা ও কাজে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। সরকারের পরিবার পরিকল্পনা নীতির ক্ষেত্রে প্রধান দুর্বলতা হলো, যেসব পরিবারে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বেশি প্রয়োজন, সেসব পরিবারই এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৬৫ জন বাস করে (চীনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫০, ভারতে ৪৫০ জন)। প্রতিবছর মোট জনসংখ্যার সঙ্গে নতুন করে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ যোগ হচ্ছে। নগর রাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত কম আয়তনে এত বেশি মানুষ বাস করে না। নীতিনির্ধারকেরা চীন ও জাপান এক সন্তান নীতি থেকে সরে এসেছে বলে যে যুক্তি দেখাচ্ছেন, সেটি জনাধিক্যের চাপে প্রায় ন্যুব্জ বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়।

আমরা মনে করি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকারের এই নীতি ও স্লোগান দুটোই ভুল। মধ্যম আয়ের স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশে এখনো ৪ কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যাও দুই কোটির কাছাকাছি, জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত। এ
অবস্থায় সরকারের উচিত হবে ভুল নীতি ও স্লোগান আঁকড়ে না ধরে বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নেওয়া।