মুক্তি চাইছেন 'মহসিন-এ-পাকিস্তান'

আবদুল কাদির খান
আবদুল কাদির খান

পাকিস্তানের বড় এক গর্ব তার পারমাণবিক বোমা। কিন্তু এই ‘বোমার জনক’কে নিয়ে দেশটি মুশকিলে আছে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আবদুল কাদির খান লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে আরজি করেছেন, তাঁকে যেন সাধারণ মানুষের মতো বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া হয়। ‘মুক্তভাবে’ চলাচল করতে চান তিনি।

আবদুল কাদির খানকে পাকিস্তানিরা ‘একিউকে’ বলে। ৮৩ বছরের একিউকে পাকিস্তানে দলমত-নির্বিশেষে সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। বেসামরিক সব খেতাবই পেয়েছেন। ভালোবেসে তাঁকে ‘মহসিন-ই-পাকিস্তান’ বলা হয়। অর্থাৎ, তিনি হলেন ‘পাকিস্তানের কল্যাণকারী’। কিন্তু লাহোর কোর্টে একিউকের ‘মুক্তি’র আরজি এই কল্যাণকারীকে নিয়ে পাকিস্তানের বিব্রতাবস্থা এবং লুকোচুরির কথাই জানাচ্ছে।

বহুদিন থেকে কিউ খানকে নিয়ে পাকিস্তান সমস্যায় আছে। ইসলামাবাদ জানাচ্ছে, ‘নিরাপত্তার কারণে পাহারা’ দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। কাদির খান নিজে সেই পাহারা চাইছেন না অবশ্য! ২০০৯ থেকে এই অবস্থা। তার আগে পাঁচ বছর ইসলামাবাদে আরও কঠোরভাবে একটি বাড়িতে বন্দী ছিলেন। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৫০ জন নিরাপত্তা কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকতেন সেখানে। দীর্ঘ আইনি যুদ্ধ শেষে সেই বন্দিত্ব শেষ হলেও ১০ বছর ধরে তাঁর চারপাশে অদৃশ্য পাহারা ও নজরদারি রয়েছে। হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি।

একিউকে ও তাঁর স্ত্রী কি সত্য বলছেন?

মূলত যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ২০০৪ সালে কাদির খানকে ‘আটক’ করে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ দেখায়, কীভাবে ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক প্রযুক্তি দিয়েছেন একিউকে। খান নিজেও এ বিষয়ে একপর্যায়ে স্বীকারোক্তি দেন। পরে সেটা অস্বীকারও করেন। তাঁর দাবি, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থেকে দেশকে বাঁচাতে তিনি রাজি হন তাতে।

কাদির খান এবং তাঁর ডাচ স্ত্রী বিজ্ঞানী হেনড্রিনা খান বলছেন, যে ধরনের নিরাপত্তার মধ্যে তাঁরা রয়েছেন, তাতে সশস্ত্র বাহিনীকে এড়িয়ে আন্তর্জাতিক কোনো নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকা কিংবা প্রযুক্তি পাচারের সুযোগ নেই। কিন্তু ব্যাপারটা একদম তাঁদের দাবির মতো নয়।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা প্রথম দাবি করেন, কাদির খান একটি বৈশ্বিক চক্রের সঙ্গে জড়িত, যারা পারমাণবিক প্রযুক্তি বিক্রিতে লিপ্ত। যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে পারমাণবিক প্রযুক্তির একজন চোরাকারবারি হিসেবে তুলে ধরে। এই দাবির সপক্ষে ভালো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল। সুইজারল্যান্ডের এক প্রযুক্তিবিদ পরিবার তদন্তে সিআইএকে সাহায্য করে। এই পরিবারের পিতা ফ্রেডরিক টিনার এবং তাঁর দুই পুত্র বহুদিন থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তির গোপন বাজারের সঙ্গে জড়িত। ১৯৭৫ থেকে কাদির খানের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ। একিউকের দেওয়া প্রযুক্তিতে টিনার পরিবার দুবাই ও মালয়েশিয়ায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের যন্ত্রাংশ উত্পাদন করত।

সিআইএর জন্য মুশকিলের দিক হলো, এই গোপন বাজার থেকে সহায়তা পেতে অনেক বন্ধুদেশকে অতীতে তারা সাহায্য করেছে। আবার টিনার পরিবার কিছু ক্ষেত্রে প্রযুক্তি গোপনে বিক্রি করলেও তার তথ্য বিক্রি করত সিআইএর কাছে। এভাবেই তারা গাদ্দাফির পারমাণবিক বোমা নির্মাণ উদ্যোগের কথা সিআইএকে জানায়। কাদির খানকে নিয়ে তদন্ত যত এগোচ্ছিল, ততই এসব তথ্য সামনে আসছিল। বিশেষত, জাতিসংঘ তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ায় এবং সুইজারল্যান্ডে এ বিষয়ে ‘এ স্পাই ফ্রম দ্য রাইন ভ্যালি’ নামে একটি অনুসন্ধানী ডকুমেন্টারি তৈরির পর সিআইএ ২০০৪-এ টিনার অধ্যায়ের তদন্ত থামিয়ে দেয়। সবাই তখন বুঝতে পারে, টিনার নেটওয়ার্ক থেকে ইরান ও উত্তর কোরিয়া সহায়তা পাওয়াতেই কেবল সিআইএ উদ্বিগ্ন এবং কাদির খানকে নিয়ে তাদের আপত্তিও মূলত এটুকুই।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতমুখী ভূমিকা

একিউকে বহুবার বলেছেন, ভারতের বোমার বিপরীতে ‘পাকিস্তানকে নিরাপদ করাই ছিল এই অস্ত্র তৈরিতে তাঁর অনুপ্রেরণা। ভুট্টোকেও তিনি রাজি করান। কিন্তু দেশের প্রধান বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক কোনো চক্রে যুক্ত থাকা পাকিস্তানের জন্য বিব্রতকর। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের একাংশ এ থেকে ফায়দা তুলতে তত্পর। ইসরায়েল বা ভারতের বোমার ভান্ডার নিয়ে চোখ বন্ধ রাখলেও পাকিস্তানের ‘ইসলামিক বোমা’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওই নীতিনির্ধারকেরা ‘উদ্বিগ্ন’। সিআইএর প্রধান জর্জ টেনেট (১৯৯৬-২০০৪) কিউ খানকে ওসামা বিন লাদেনের মতোই ‘হুমকি’ হিসেবে অভিহিত করেন তখন। ২০০৪ সালে পাকিস্তান নিজস্ব তদন্তেও এমন প্রমাণ পায়, যাতে ইরান ও লিবিয়ায় তাদের দেশ থেকে প্রযুক্তি পাচারের আলামত ছিল।

২০১৬ সালে ‘পানামা পেপারসে’ একিউকে পরিবারের নামে বাহামাতে নিবন্ধিত একটি কোম্পানিরও সন্ধান মেলে। এতে সন্দেহ বাড়ে, আন্তর্জাতিক পরিসরে অর্থ লেনদেনে তিনি জড়িত থাকতেও পারেন।

এসব তথ্য ইউরোপের জন্যও বিব্রতকর। বিভিন্ন তদন্তে তথ্য মিলেছে, একিউকে নেদারল্যান্ডসে ব্রিটেন ও জার্মানির সমন্বয়ে গড়ে তোলা পারমাণবিক প্রযুক্তিবিষয়ক বহুজাতিক সংস্থা ‘ইউরেনকো’তে কাজের সময় প্রযুক্তিটি আদ্যোপান্ত ‘চুরি’ করেন। এর প্ল্যান্ট ছিল নেদারল্যান্ডসের ‘আলমেলো’তে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত একিউকে ওখানে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকেই ‘কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে’ পাকিস্তানে আসেন। অর্থাৎ একিউকের ‘প্রযুক্তি স্থানান্তর প্রক্রিয়া’র শুরু ইউরোপ থেকে! এ বিষয়ে ডাচ আদালতে তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৯৮৩ সালে চার বছর কারাভোগের রায়ও হয়। প্রক্রিয়াগত ভুলের কারণে পরে ওই রায় বাতিল হয়। অজ্ঞাত কারণে আদালতের সেই ফাইলটি এখন পাওয়া যায় না। অনেকের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র সেটা হস্তগত করে নিয়েছে। মামলার শুনানিতে এ তথ্য উঠে এসেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের চাপে নেদারল্যান্ডস অন্তত দুইবার কাদির খানকে আটক করতে পারেনি। তার মানে দাঁড়ায়, ইউরেনকো থেকে পাকিস্তানে কাদির খানের ‘প্রযুক্তি স্থানান্তর’ যুক্তরাষ্ট্রের অজানা ছিল না। তাদের আপত্তির শুরু সেটা ইরান, লিবিয়া, উত্তর কোরিয়া গমনে!

পাকিস্তান চাইছে একিউকে মুখ বন্ধ রাখুন

এ মুহূর্তে কাদির খানকে ব্যবহারিক গবেষণাগারগুলোতে সরিয়ে আটক ও নিয়ন্ত্রণে রেখে পাকিস্তান বোঝাতে চায়, পারমাণবিক প্রযুক্তি ছড়ানোর কাজে রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা যুক্ত নয়। তবে পাকিস্তান একিউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দিতেও অনিচ্ছুক। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র এরূপ সুযোগ চাইছে। সেটা চাওয়া হচ্ছে আসলে পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির গভীরতা বুঝতে এবং চীন তাতে কতটা যুক্ত, সেটা জানতে।

পাকিস্তানের শাসকদের জন্য বড় সমস্যা, কাদির খানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিলে দেশটিতে জনবিক্ষোভ হবে। এ ছাড়া বোমা তৈরি করতে গিয়ে ‘টিনার নেটওয়ার্ক’ থেকে পাকিস্তানও নানান ধরনের সরঞ্জাম ক্রয় করেছে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও জার্মানির কালোবাজার থেকে। সবকিছু হয়েছে খানের পরামর্শেই। ইউরোপের গোপন পারমাণবিক প্রযুক্তি বাজার সম্পর্কে তাঁর রয়েছে বিস্তারিত জ্ঞান। ফলে তাঁকে মুখ খুলতে দেওয়া যায় না। খান নিজেও সেটা জানেন। তাই আপাতত দর-কষাকষি করে নিজের জন্য খানিকটা স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইছেন।

একিউকে বলছেন, দেশের বাইরে যাবেন না, কেবল দেশে নিজের মতো চলাফেরা করতে চান। আশি ঊর্ধ্ব বয়সী প্রিয় ব্যক্তির এরূপ চাওয়ায় পাকিস্তান পেরেশানিতে পড়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তারপরও গত ১৫ বছর তাঁকে নিজের গড়া গবেষণাগারে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এখন যদি তাঁকে মুক্তভাবে চলাফেরার অধিকারও দেওয়া না হয়, সেটা জনগণের কাছে ন্যায়সম্মত প্রমাণ করা কঠিন।

পারমাণবিক প্রযুক্তি বিকাশের ভারতীয় অধ্যায়েও ভিন্ন ধাঁচের এ রকম অনেক গল্প আছে। ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশে মেধাবী প্রযুক্তিবিদেরা সমরাস্ত্র খাতের উন্নয়ন ঘটিয়ে স্থানীয় জাতীয়তাবাদীদের ক্ষমতালিপ্সার জ্বালানি জোগাচ্ছেন মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাতে মদদ দেয় ভূরাজনৈতিক স্বার্থে। যে ভূরাজনীতি থেকে প্রযুক্তিবিদেরাও রেহাই পাচ্ছেন না এখন। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দুই শ কোটি মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায়ও পড়েছে আজ।

উগ্র জাতীয়তাবাদ তার অস্তিত্বের শেষ লগ্নে এই বোমা ব্যবহার করবে না, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। কিন্তু এই অবস্থার দায় কার? শুধুই প্রযুক্তির? নাকি অতি জাতীয়তাবাদী প্রযুক্তিবিদদের?

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক