রিকশা কেন সহজ টার্গেট?

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

৮ জুলাই। ঢাকার মুগদা এলাকার রিকশাচালকদের মিছিলে আবদুল হামিদ ছিলেন বেশ বিক্ষুব্ধ। চিৎকার করে বলছিলেন, ‘সরকারের কাছে একটাই দাবি, যেভাবে রাস্তাটা আগে খোলা ছিল, সেইভাবে দিলে পরে আমরা সরকারের কাছে আর কোনো কিচ্ছু চাই না। আমাদের গাড়িটা যদি বন্ধ করে দেয়, তাইলে কীভাবে ঘরভাড়া দিব, কীভাবে পোলা-মাইয়া লেখাপড়া করাব? কীভাবে আমরা কী করব?’

 কুড়িগ্রামের চিলমারীর আবু হানিফের বেটা তিনি। হানিফ নৌকা চালাতেন চিলমারী বন্দরে।

নগরপিতার চোখে নাগরিক বদভ্যাস

রাজধানীতে যানজট কমানো এবং ট্রাফিক শৃঙ্খলা আনতে গাবতলী থেকে আজিমপুর, সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ ও কুড়িল থেকে খিলগাঁও হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত রিকশা নিষিদ্ধ করে দুই সিটি করপোরেশন। ৭ জুলাই এক মেয়র বলেন, ‘রিকশা বন্ধ হলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্কুলগামী শিশুদের বহনকারী ভ্যানগুলো চলাচল করতে পারবে।’ সেটি হয়নি। স্কুলভ্যান নিয়েও পুলিশ টানাটানি করেছে, শিশুদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। সেসব ছবি দেখেছে জনগণ। রোদ-বৃষ্টি-বিপদে রিকশাচালককেই পাই আমরা সবার আগে। ৭ জুলাইয়ের ভাষণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, ‘আমাদের হাঁটার অভ্যাস করা উচিত। সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে। এ শহরের শৃঙ্খলার জন্যও ভালো হবে।’ জি, এই সুন্দর গতিশীল নগরে নাগরিকদের বদভ্যাস আছে। তাঁরা নগরপিতা—অভিভাবক। তাঁরা ভিআইপি গতিতে গাড়িতে চড়ে ঘুরে অলস নগরবাসীকে বদভ্যাস সংশোধনের নসিহত করতেই পারেন। যাঁদের গাড়ি নেই, যাঁরা খানাখন্দ-ভিড় ঠেলে, বাসে ঝুলে জরুরি প্রয়োজনে যাতায়াত করেন, তাঁরা জানেন, এ শহরে জীবন মানে যন্ত্রণা। নগরপিতারা জানেন না। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জীবনের সঙ্গে তাঁদের হয় নাকো দেখা।

রিজিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রিকশাশ্রমিকেরা শেষ পর্যন্ত ৮ জুলাই সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ জনপদ মোড় থেকে মুগদা, মানিকনগর ও খিলগাঁও এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। রিকশাচালকদের এই বিক্ষোভে এলিট মহলের রাজনীতিকদের কাউকে দেখা যায়নি। রিকশা কেউ শখ করে চালায় না। সব জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেলে জীবিকা-বিপন্নরা শহরে আসেন রিকশা চালাতে। তাঁদের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও আছেন। আছেন শিক্ষার্থীদের টাকার জোগানদার পিতারা। অনেক শিক্ষক তাঁর ছাত্রের রিকশা চালনার খবরে চমকে ওঠেন কিংবা বিব্রত হন। আমাদের কোনো কোনো ছাত্র চুপিসারে রিকশা চালিয়ে নিজের খরচ চালান, ভাইবোনদের খরচ জোগান। এটাই এখন বাস্তবতা। অনেক পরিবর্তন আর উন্নয়নের পর সেই করুণ-কঠিন বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই আর বদলায়নি।

রিকশা কি যানজটের একমাত্র কারণ?

নিউ এলিফ্যান্ট রোডের দোকানপাট মঙ্গলবার বন্ধ থাকে। সেদিন ওই রাস্তায় গেলে মনে হবে, আজ এত ফাঁকা কেন? কেউ কি আবার হরতাল ডাকল নাকি? রাস্তার গা ঘেঁষে, ওপরে আর ফুটপাতে দোকানপাট, মালপত্র রাখা বন্ধ করলে ৬৫ শতাংশ যানজট উধাও হয়ে যাবে। ঢাকার রাস্তায় আড়াই লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি চলে। প্রতিবছর গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রাইভেট কারের লাইসেন্স দিচ্ছে বিআরটিএ। মাত্র ৬ শতাংশ যাত্রী বহন করে রাস্তার ৭৬ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে এসব প্রাইভেট কার (ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল জরিপ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭)।

নবাবপুর রোডের যানজট দূর করার জন্য অনেক মানুষের চৌদ্দপুরুষের ভিটাবাড়ি উচ্ছেদ করে পুরান ঢাকার বুক চিরে নর্থ সাউথ রোড বানানো হয়েছিল। কথা ছিল, এই রাস্তায় কোনো দোকানপাট বসবে না। রিকশার আলাদা লেন থাকবে—শুরুতে তা-ই হয়েছিল। আমরা আরমানিটোলা থেকে সহজেই চলে আসতাম গুলিস্তান। সেই সুখ বড়জোর ছয় মাস ছিল। দোকান থেকে মার্কেট হলো, রিকশার লেন হাপিস হয়ে গেল ব্যবসা আর টাকার কাছে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে রিকশাচালকদের অবদান

বলা হয়, আমাদের মুখ থুবড়ে পড়া কৃষি এখনো চলছে রিকশাচালকদের পয়সায়। তাঁদের রোজগারের টাকায় অলাভজনক কৃষির ভর্তুকি চলে। কেনা হয় সেচের পানি, সার, লাঙল, বীজ, কীটনাশক, জমির ‘কোট’ (মালিকের আগাম পাওনা)। আর শেষ পর্যন্ত থাকে লোকসানের ঋণ। আমরা নোংরা নগরে বসে তাই শাকসবজি আর চাল-ডালের মুখ দেখতে পাই। হালের মোবাইল মানি ট্রান্সফারের নিকাশ দেখলেই বোঝা যাবে, রিকশাশ্রমিকেরা কী হারে টাকা পাঠিয়ে বাঁচিয়ে রাখছেন গ্রামের অর্থনীতি। আমরা বিদেশি রেমিট্যান্সের হিসাব রাখি কিন্তু নগরগুলো থেকে গ্রামে পাঠানো টাকার খবর রাখি না। উদাস অর্থনীতিবিদেরা চেষ্টা করতে পারেন এই হিসাব মেলানোর।

রিকশা কেন টার্গেট?

একাত্তরের দখলদার পাকিস্তানিরা ঘুমিয়ে থাকা রিকশাশ্রমিকদের আগে মেরেছিল। তাদের কাছে খবর ছিল, কোনো কিছু হারানোর ভয় না থাকা এই মানুষগুলো মিছিলে নামেন সহজে। সংগঠিত হতে তাঁদের সময় লাগে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসের রিকশাচালক হাড্ডি খিজিরকে পাই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের এক অবিস্মরণীয় চরিত্রে। একাত্তরে কতিপয় রিকশাচালককে খুন করে তারা ভেবেছিল কেল্লা ফতে। তা হয়নি। সেদিন বেঁচে যাওয়া অনেক শ্রমিক বাড়ি না ফিরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, স্বাধীন দেশে তাঁদের সুদিন আসবে, জীবন বাঁচবে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কোনো দিন লেখা হলে এ কথার সত্যতা মিলবে।

সুদিন ঠিকই এসেছে কিন্তু সবার জন্য নয়। জীবিকা-বিপন্ন রিকশাশ্রমিকদের জন্য তো নয়ই। ঢাকার রাস্তা পরিষ্কার রাখার প্রথম বাধা হিসেবে
ধরা হচ্ছে রিকশাচালকদের। কারণ তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তাঁরা গাছের ডালে ঝুলে থাকা সবচেয়ে কাছের ফল, তাই তাঁদের টুঁটি চেপে ধরা সহজ। তাঁদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের রূপ নিলে অনেক ‘প্রগতিশীলও’ দাঁড়াবে না তাঁদের পাশে। না খেয়ে, না দেয়ে কদিন তাঁরা পুলিশের ধরপাকড় সামলে টিকে থাকতে পারবেন এই ‘শত্রু নগরীতে’?

যারা রাস্তার ৭৬ শতাংশ জায়গা দখল করে মাত্র ৬ শতাংশ যাত্রী বহন করে, তারা উঁচু ডালের ফল। রাস্তার পাশে দোকান আর প্রতিষ্ঠান, যারা ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ স্থবিরতার জন্য দায়ী, তারাও থাকে মগডালে। কে ছোঁবে তাদের। রিকশা থামলে যদি রাস্তা পরিষ্কার হতো, তবে কথিত ভিআইপি রোডে বসে কেন গাড়ির এসি ছেড়ে আমরা গান শুনি ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে গাড়ি চলে না’!

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem 5508 @gmail.com