ডিসি সম্মেলন: কোথায় আছে কেমন আছে সংবিধান

ডেপুটি কমিশনাররা বাংলাদেশের জনপ্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণ যোগ্যতর ও জনবান্ধব বহু ডিসির দেখা অতীতেও পেয়েছে, এখনো পায়। সুতরাং ডিসিদের বার্ষিক সম্মেলন জাতীয় পঞ্জিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। কয়েক বছর ধরে ডিসিদের বিচারিক ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নেওয়ার দাবিই জোরালো হচ্ছিল। এবার আরও অনেকগুলো নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে এসব দাবিদাওয়ার সঙ্গে সব ডিসি একমত, বিষয়টি তা নয়। আলাদাভাবে ডিসিদের তরফে যেসব প্রস্তাব এসেছে, তাতে ব্যক্তির মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে। এতে পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা টিভি চালু, প্রতি জেলায় খাদ্যনিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মার্ট কার্ড দেওয়ার মতো কতগুলো উত্তম সাধারণ প্রস্তাব আছে।

তবে এমন কিছু দাবির কথা জানা গেছে, যা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য পৃথক ব্যাংক, তাদের প্রশাসনিক দপ্তরের নিরাপত্তায় স্পেশাল ফোর্স গড়ে তোলা, দিবস উদ্‌যাপনে বছরে কোটি টাকা বরাদ্দ, জ্বালানি তেল ব্যবহারের সীমা তুলে নেওয়া এবং ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা অর্জন করা। এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন খুবই সংগত যে দাবি উত্থাপনকারী ডিসিরা কি তাঁদের সাংবিধানিক এখতিয়ার বিষয়ে সচেতন? মানতে মন সায় দেয় না। প্রতিটি জেলা একটি করে ‘প্রশাসনিক একাংশ’। সংবিধান বলেছে, নির্বাচিতদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের ওপর ‘স্থানীয় শাসনের’ ভার থাকবে।

১৯৯১ সালে সদ্য প্রয়াত জেনারেল এরশাদের চালু করা উপজেলা পরিষদ বাতিল মামলাটির (কুদরত-ই-ইলাহি পনির) ঐতিহাসিক রায়টি প্রণিধানযোগ্য। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের তাতে নির্দেশনা ছিল, জেলাসহ প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশ সব পরিস্থিতিতে শুধু নির্বাচিতরাই চালাবেন। যখন পরোক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ সৃষ্টি করা হলো, তখনই আশঙ্কা ছিল, মাঠের আমলাতন্ত্র মাঠের নির্বাচিতদের গিলে খাবে। তাই হলো। ডিসি সম্মেলনে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা একটা দাওয়াত পর্যন্ত পান না। ডিসি সম্মেলন ক্রমাগতভাবে একটা সাংঘাতিক আমলাতন্ত্রের উত্থান ঘটাতে পারে, যারা সংবিধানের ভেতরে থাকবে না। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার এসিআর লেখা এবং ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের মতো অসাংবিধানিক দাবি জানানোর মধ্যে সেই লক্ষণ স্পষ্ট। সংবিধান ও আপিল বিভাগের ওই রায় অনুযায়ী, ইউএনও এবং ডিসির এসিআর লেখার কথা যথাক্রমে উপজেলা ও জেলা চেয়ারম্যানের।

সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রতি জেলার ‘স্থানীয় শাসনে’ তিনটি বিষয় থাকবে। প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্য, জনশৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন পরিকল্পনা-প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। এখন আমরা দেখছি জেলা পরিষদের নির্বাচিতরা নন, বরং ডিসিরা ভুল বাংলা তরজমায় ‘জেলা প্রশাসক’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। রাজনীতিকেরাই এটা করেছেন। এ জন্য শুধু আমলারা দায়ী নন। সুতরাং বর্তমানে জেলা প্রশাসন যেভাবে চলছে, তাতে সংবিধান আঘাত পাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের লঙ্ঘন ঘটছে। আর ২০১৯ সালে ডিসিদের ৩৩৩টি প্রস্তাবের মধ্যে অনেকগুলো তাঁদের তরফে আসারই কথা নয়। কিন্তু তাঁরা যখন বলেই ফেলেছেন, তখন সরকারের তরফে আমরা নির্দিষ্ট বক্তব্য আশা করব। ঝুলিয়ে রেখে, নীরব থেকে বা গোপনে দিয়ে দেওয়ার মতো কোনো প্রক্রিয়া আমরা দেখতে চাই না। ডিসিদের দিয়েই যদি সবকিছু সরকার উদ্ধার করতে চায়, তাহলে তাঁদের খুশি রাখতে সরকার যা করার করবেই। সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায় অগ্রাহ্য করে বিচারিক ক্ষমতায় আমলাদের যুক্ত করার চলমান প্রক্রিয়া তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

আমাদের আমলাতন্ত্রের একটি বড় অংশ বিচার বিভাগ পৃথককরণ কোনো দিন মন থেকে মানতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র ১৯৫৬ সালে এবং পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি আমলাতন্ত্র ১৯৭২ সালে নতুন সংবিধান তৈরিকালেই বিচার বিভাগের পৃথককরণ ঠেকাতে পেছন থেকে আঘাত করেছিল। রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্র এই সত্য স্বীকারে ঐতিহাসিকভাবে ভীরু। তবে সত্যি বলতে কি, দেশের আমলাতন্ত্রের সব থেকে শ্রদ্ধাশীল অংশটিও বিচার বিভাগ পৃথককরণের ব্যাপারে খুব অস্বস্তিতে ভোগে। কারণ, ২০০৭ সালে এক-এগারোতে মাসদার হোসেন মামলার রায়সূত্রে যে অগ্রগতি এসেছে, সেটা তারা মানতে পারছে না।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পরে যেন আরও দিন ফিরেছে ডিসিদের। সুতরাং ডিসিরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বিচারিক ক্ষমতা ফিরে পেতে সরব। যেসব দেশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করছে, সুশাসন দিয়েছে, সেসব দেশে যাঁরা রাতে চোর ধরেন, তাঁরাই রাত পোহালে বিচার করেন—এমন কোনো দৃষ্টান্ত বিশ্বে নেই। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, যাঁরা নিজ গুণে জনগণের চোখে মনীষী হয়েছেন, তাঁরা বলুন এই বক্তব্যে কোনো ভুল আছে কি না। বিশ্বে কে কবে শুনেছে, কিংবা কে কোথায় লিখেছে যে প্রজাতন্ত্রের বিচারিক ক্ষমতায় নির্বাহী বিভাগের অংশীদারত্ব আছে বা সরকারি কর্মকর্তারা বিচারক হলে মানুষ ভালো ফল পায়। একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সম্প্রতি লিখেছেন, ‘সমসাময়িক কালে কয়েকজন অতি সাহসী কিন্তু সজ্জন ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় এনে নন্দিত হয়েছেন। গণমাধ্যমসহ সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছেন তাঁরা। এখনো এরূপ অনেকেই আছেন বহু ক্ষেত্রে। কিন্তু গুটি কয়েক অদূরদর্শী কর্মকর্তার আচরণ গোটা ব্যবস্থাটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’ চলমান মোবাইল কোর্ট আইনটিকে হাইকোর্ট ‘অসাংবিধানিক’ বলেছেন। তদুপরি ওই সাবেক সচিবের মতে, এটি ‘প্রয়োজনীয়’।

৩০ লাখ বিচারাধীন মামলার জটের জন্য প্রশাসন কতটা দায়ী, তা নিয়ে ডিসি সম্মেলনে আলোচনা হওয়া উচিত। বিচার বিভাগের উচিত হবে এ রকম একটি মামলার তালিকা করা, যেখানে প্রশাসনের দায় চিহ্নিত হয়। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি, কয়েক বছর ধরে প্রতিটি সম্মেলনে বিচারিক ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নেওয়ার দাবি জোরালো করছেন ডিসিরা। ২০০৯ সালে সিআরপিসির ১৯০ ধারায় ৪ উপধারা হিসেবে একটি নতুন বিধান যুক্ত করে রেখেছে। এতে যা বলা হয়েছে তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। সেখানে বলা আছে, সরকার চাইলেই যেকোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর করা হয়নি, কিন্তু ডিসিরা এটা পেতে একটা প্রেশার গ্রুপ হয়ে উঠেছেন। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ না করেই গত ১০ বছরে সরকার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে এক শর বেশি আইনের আওতায় ডিসিদের অধীন কর্মকর্তাদের অনধিক দুই বছরের জেল দেওয়ার মতো ক্ষমতা দিয়েছে। সংসদকে পাশ কাটিয়ে তারা এটা দিয়েছে।

প্রতিবছর ডিসিদের সম্মেলন এলেই তাঁরা বিচারিক ক্ষমতায়ন প্রশ্নে যা কিছু বলেন, তা সংবিধানের এবং মাসদার হোসেন মামলার মাইলফলক রায়কে লঙ্ঘন করে। ইতিহাসে এই প্রথম সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতে যাচ্ছেন ডিসিরা। তবে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রোববার রুশ প্রধান বিচারপতির আমন্ত্রণে দেশত্যাগ করেছেন। তাঁর পরিবর্তে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. ইমান আলী কাল মঙ্গলবার তাঁদের সাক্ষাৎ দেবেন।

সুপ্রিম কোর্টে ডিসিরা কেন যাবেন? জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, মন্ত্রিপরিষদ থেকে আসা চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ডিসিরা ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ করবেন।

আমরা শুধু স্মরণ করতে পারি, মোবাইল কোর্ট, আদালত অবমাননা আইন, অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষমতা, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স এবং পে-কমিশনের মতো কতগুলো মৌলিক প্রশ্নে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের টানাপোড়েন লুকোছাপার বিষয় নয়।

মিজানুর রহমান খান:প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]