এরশাদের বিচার, না বিচার

এইচ এম এরশাদ । ছবি: এএফপি
এইচ এম এরশাদ । ছবি: এএফপি

এরশাদ আর নেই—গতকাল প্রথম আলোর অনলাইনে খবরটি পড়ে মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জাগল। তিনি একজন রাজনীতিক, একটি দলের প্রধান এবং একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা। এটি হলো তাঁর এখনকার পরিচয়। কিন্তু এই পরিচয়ের বাইরেও তাঁর অনেকগুলো পরিচয় ছিল। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। অবশ্য সেই ঘোষণা তিনি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন কয়েক মাস আগে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বয়োবৃদ্ধ আবদুস সাত্তারকে দিয়ে। বিচারপতি সাত্তার তাঁর সরকারকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে অভিহিত করে সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে দেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন যে বন্দুকের নলের মুখে সেই ঘোষণা এসেছিল।

পৃথিবীর সব সামরিক শাসকের মতো তিনিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জনগণ তাঁকে দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক হিসেবেই দেখেছে। তাঁর শাসনের প্রায় পুরো সময়টাই জনগণ আন্দোলন–সংগ্রাম করেছে। ছাত্র-তরুণেরা, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাজপথে ছিলেন। সেলিম, দেলোয়ার, বসুনিয়া, দীপালি সাহা, তাজুল, নূর হোসেন, মিলনসহ বহু তরুণ জীবন দিয়েছেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।

এরশাদের শাসনকাল কীভাবে মূল্যায়িত হবে? কেউ বলবেন, তাঁর সময়েই বাংলাদেশে উন্নয়নের ধারা বেগবান হয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন তাঁর প্রধান কৃতিত্ব হিসেবে দেখা হবে। আবার কেউ বলবেন, তিনি গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন, বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় এসেছেন, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শুরু করে শিল্পকারখানাগুলোতে দলীয় মাস্তান ও ক্যাডার সৃষ্টি করেছেন। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দলে ভিড়িয়েছেন। কিন্তু এসব অভিযোগ তাঁর পূর্বাপর সব শাসকের বিরুদ্ধে কমবেশি ছিল।

নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মূল কথা ছিল স্বৈরাচারের পতন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এরশাদের বিদায়ের পর আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের অঙ্গীকার ছিল এরশাদ ও তঁার সহযোগীদের কাউকে দলে বা জোটে নেওয়া হবে না। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে, দুই জোটেই তাঁর সহযোগীরা দারুণ দাপটে আছেন। তাঁর সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ দুবার ক্ষমতায় এসেছে। বিএনপিও আসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে তিনি ছিলেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা। বামদলীয় ও বিএনপির সাংসদেরা তাঁর নেতৃত্ব মেনেই সংসদে বসেছেন। আজকের প্রজন্ম এরশাদকে যেভাবে দেখবে, আশির দশকের প্রজন্ম সেভাবে দেখবে না। কেননা তাঁদের চোখের সামনে ভাসবে অসংখ্য শহীদের মুখ।

 বাংলাদেশের দুজন সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীতে থাকতে সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আবার জিয়া যখন সেনাপ্রধান, তখন এরশাদ ছিলেন উপ–সেনাপ্রধান। তিনি সেনাবাহিনী প্রধান হন জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করার পর।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হওয়ার পর এরশাদ নতুন ভূমিকায় আসেন। জিয়ার হত্যাকারীদের বিচারে তাঁর সমর্থন ও উৎসাহ ছিল। আবার ১৯৮১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেনের বিপরীতে বিচারপতি সাত্তারকে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছিলেন তিনি। এরশাদ মনে করেছিলেন, বয়োবৃদ্ধ বিচারপতিকে দিয়ে তিনি যা করাতে পারবেন, সেটি অন্যকে দিয়ে সম্ভব নয়। ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের পর থেকেই এরশাদ ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর হিস্যা পেতে ১২ দফা দাবিও পেশ করেছিলেন। সেনানেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব দেয়ালে পিঠ ঠেকানোর অবস্থায় চলে যায়, যার পরিণতি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। তবে এরশাদ প্রথমে বিচারপতি আহসানউদ্দিন আহমদকে শিখণ্ডী রাষ্ট্রপতি করে নিজে প্রধান সামরিক প্রশাসক হন। পরে দুটো পদই দখল করেন। তাঁর শাসনকালের পুরোটাই ছিল ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ, আন্দোলনমুখর।

ধারণা করা গিয়েছিল, ক্ষমতা ত্যাগের মধ্য দিয়ে এরশাদ ও তাঁর সহযোগীদের রাজনৈতিক জীবন শেষ হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। ক্ষমতাপিয়াসী দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বিরোধের সুযোগ নিয়ে এরশাদ তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব বহাল রাখতে পেরেছিলেন। দুই প্রধান দলের মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগকে মিত্র হিসেবে নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরশাদের রাজনৈতিক শক্তিই ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার বৈরিতা। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা যা–ই হোক না কেন, নব্বই দশক ও এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে কোনো দল এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারেনি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে, তিনিই ২৯ বছর ধরে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা।

তবে এরশাদের রাজনৈতিক জীবন প্রলম্বিত হলেও তিনি নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণ করতে পারেননি। তিনি দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন। মৃত্যুর সময়েও তাঁর বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলা ছিল। আমাদের রাজনীতিকেরা মুখে গণতন্ত্রের যে বুলি আওড়ান ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা ক্ষমতা ধরে রাখতে তার কিছুই মানেন না, এবং সেটাই এরশাদের রাজনৈতিক জীবনকে প্রলম্বিত করেছে। এরশাদের শাসনের সঙ্গে তাঁর আগের ও পরের শাসনকেও মিলিয়ে অনেকে তাঁর শাসনের প্রশংসাও করছেন। একটা কথা স্বীকার করতে হবে যে স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে এক দশক ধরে সেনাবাহিনীতে যে বিশৃঙ্খলা ও উপদলীয় সংঘাত ছিল, এরশাদের আমলে তা প্রশমিত হয়েছে। জিয়ার আমলে ১৭–১৮টি সেনা অভ্যুত্থান হলেও এরশাদের আমলে একটি অভ্যুত্থানও হয়নি। এরশাদ তাঁর দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনে জনগণের আস্থা অর্জন করতে না পারলেও সেনাবাহিনীর আস্থা পুরোটাই অর্জন করেছিলেন।

মৃত্যুর আগেই এরশাদ তাঁর দল জাতীয় পার্টিতে উত্তরাধিকার নির্বাচন করে গিয়েছেন। ছোট ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান এবং স্ত্রী রওশনকে সংসদে উপনেতা করে গেছেন। এখন তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের নেতা-কর্মীরা এই ব্যবস্থাপত্র মেনে নেবেন কি না, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাঁর দলের বোঝাপড়া ঠিক থাকবে কি না, দল ছেড়ে অনেকে ক্ষমতার পক্ষপুটে আশ্রয় নেবেন কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]