কর্তৃত্ববাদের চালচিত্র

এটা একটা সাধারণ অভিযোগ যে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে আদর্শ উধাও হয়ে গেছে। রাজনীতি হয়ে উঠেছে অর্থ, বিত্ত ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার বাহন। আমাদের চারপাশে তাকালে দেখা যায়, নানা রঙের রাজনৈতিক দল সমাজের ওপর দখলদারি কায়েমের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে। এ লড়াই ভোটের বাক্স ছাপিয়ে ঘরে-বাইরে, মাঠে-ময়দানে ছড়িয়ে পড়েছে। খুনোখুনি বাড়ছে। পরস্পরবিরোধী দলের সমর্থকদের ঝগড়া-মারামারিতে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। একটা সময় ছিল, যখন রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় নিহত ব্যক্তি শহীদের মর্যাদা পেতেন। এখন আর এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।

একদা এই সমাজে চর দখলের জন্য জমিদার-জোতদারেরা লাঠিয়াল বাহিনী পুষতেন। লাঠিয়ালেরা নিজ নিজ মালিকের পক্ষ নিয়ে মারতেন এবং মরতেন। লাঠিয়ালদের নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাঁদের মালিকেরা পুকুর-দিঘি কেটে কিংবা স্কুল-মাদ্রাসা-এতিমখানা বানিয়ে দানবীর হিসেবে
প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। নিহত লাঠিয়ালেরা কারও স্মৃতিতে নেই। তেমনি রাজনীতিবিদদের পোষ্য বা চেলা-চামুণ্ডারা মারপিট করে মরে গেলেও ইতিহাসে তাঁদের জন্য এক ইঞ্চি জায়গাও থাকে না। রাজনীতিবিদেরা অনেকেই তারকাখ্যাতি পেয়ে যান। তাঁদের নামে রাস্তাঘাট, সেতু, ভবন ইত্যাকার অনেক স্থাপনা
তৈরি হয়।

একসময় দলের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বীকে খুন করা রাজনৈতিকভাবে জায়েজ ছিল। বিশেষ করে বামপন্থী দাবিদার দলগুলোর মধ্যে। আমাদের অনেকেরই স্মরণ আছে, ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক হুমায়ুন কবিরকে তাঁর ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গুলি করে মারা হয়েছিল। পরে জানা যায়, তিনি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মধ্যকার অন্তঃকলহের শিকার হয়েছিলেন। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, হুমায়ুন নাকি দলের প্রধান নেতা সিরাজ সিকদারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। ১০ জুন ১৯৭২, সর্বহারা পার্টির এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাতে গিয়ে হুমায়ুন কবির পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির গেরিলাদের হাতে খতম হয়।’

এ দেশের বাম ঘরানার কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে ভিন্নমতের সহাবস্থান মেনে নেওয়া হতো না। ভিন্নমতের কারণে অনেককেই দলের কমরেডদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। সবই হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র নামে। সেখানে কেবলই ছিল কেন্দ্রিকতা। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি বাম দলগুলোকে পুরোপুরি গ্রাস করেছিল। একসময় দারুণ প্রচার ছিল, বাম মানেই প্রগতিশীল। যারা তাদের বিরুদ্ধে, তারা সবাই ডান এবং প্রতিক্রিয়াশীল। শহুরে মধ্যবিত্তের মধ্যে এ ধরনের মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল দীর্ঘদিন ধরে।

১৯৭০-এর দশক ছিল বামপন্থার নামে ধ্বংস ও আতঙ্কের যুগ। বিপ্লবের নামে এমনতর বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা পৃথিবীর অন্য কোথাও ঘটেছে বলে আমরা জানি না। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সেই বোকামির সঙ্গে যুক্ত শহুরে ভদ্রলোকেরা গণমাধ্যম এবং বিদ্বজ্জনের মধ্যে আজও মর্যাদার আসন পান। এই আন্দোলন যে বাঙালিকে কত দূর পিছিয়ে দিয়েছে, তার হিসাব করা যায় না।

ভিন্নমতের কারণে দলের লোককে মেরে ফেলার নাম হলো আন্তপার্টি সংগ্রাম। এ দেশের অতি বাম দলগুলোর মধ্যে এই প্রবণতা মহামারির মতো জেঁকে বসেছিল। তবে বামেরা পথ দেখালেও ডানেরা পিছিয়ে থাকেনি। ডান বা মধ্যপন্থী দলগুলোতেও এর প্রভাব পড়েছিল। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগে শুদ্ধি অভিযানের নামে একধরনের মেরুকরণ হয়েছিল। দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। এর ফলে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে ‘সাত খুনের’ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। আন্তপার্টি সংগ্রাম জাসদের ঘাড়েও সওয়ার হয়েছিল। এর বাড়াবাড়ি রকম প্রতিফলন দেখা যায় কুষ্টিয়ায়। সেখানে জ্যেষ্ঠ নেতাদের দ্বন্দ্বের আগুনে জ্বলে–পুড়ে গিয়েছিল অনেক তাজা প্রাণ। এর ধারাবাহিকতায় জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী আরেফ আহমদ বক্তৃতার মঞ্চে নিহত হয়েছিলেন। খুন করে পার পাওয়া কঠিন। একটি হত্যাকাণ্ড পরে অনেক হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেয়। কুষ্টিয়ায় এভাবেই লেখা হয়েছিল জাসদের আত্মনিধন নাটকের স্ক্রিপ্ট।

সংসদীয় গণতন্ত্র আমরা ইংরেজদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। এ হলো ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। কিন্তু আমাদের রক্তে-মাংসে-হাড়ে-মজ্জায় গণতন্ত্র প্রবিষ্ট হতে পারেনি। গণতন্ত্র একটি ধারণা এবং একই সঙ্গে একটি জীবনব্যবস্থা। ধারণাটি যেকোনো দেশের সংবিধান থেকে ধার করে নিয়ে আসা যায়। তখন আমরা বলতেই পারি, আমাদের দেশে গণতন্ত্র কায়েম হয়ে গেছে। কে বলেছে গণতন্ত্র নেই? ওই যে সংবিধানের অমুক ধারায় স্পষ্ট বলা আছে!

আমাদের সমাজে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি, যাঁরা সুযোগ পেলে নিজের মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। এটা পরিবারে, শিক্ষায়তনে, অফিসে, রাজনৈতিক দলে—সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে। এমনকি গণমাধ্যমেও এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

এ দেশে যে দুটি নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, সেই দুটিই পাকিস্তান আমলের। প্রথমটি হলো ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেও যে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যায়, তার একটি ভালো উদাহরণ হলো ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, যেখানে বিরোধী দলগুলোর জোট যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থীদের হারিয়ে একচেটিয়া জয় পেয়েছিলেন।

দ্বিতীয় উদাহরণটি হলো, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচনটি হলেও সরকার এখানে কোনো পক্ষ হয়নি। ফলে জনমতের প্রবল প্রতিফলন ঘটেছিল ওই নির্বাচনে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ অঞ্চলের একক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

বিপত্তি শুরু হলো স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনটিতে পেশিশক্তির ব্যবহার হতে দেখা যায় অনেক জায়গায়। আওয়ামী লীগের বিকল্প অন্য কোনো রাজনৈতিক দল তখনো গড়ে ওঠেনি। তবু আওয়ামী লীগের মধ্যে জোর করে ভোট পাওয়ার এবং আসন দখল করার প্রবণতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়েও অনেকে ভোট দিতে পারেননি। এ রকম একটি অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন শিক্ষক আনিসুজ্জামান। উপাচার্য ইন্নাস আলী, রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে ক্যাম্পাসের কাছে একটি ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভাষ্যে জানা যায়:

স্বাধীন দেশে এই প্রথম ভোট দিতে যাচ্ছি—মনের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সে উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। জানলাম, আমাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। আমাদের এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। নিজের ভোটটা আমি তাঁকেই দিতাম। তিনি এমনিতেই জিততেন। তবে উত্সাহী রাজনৈতিক কর্মীরা যে আশার ওপর ভর করে নিশ্চেষ্ট থাকতে চায়নি। পরীক্ষা না দিয়ে পাস করতে চাওয়া আর ভোট না দিয়ে নিজেদের প্রার্থীকে পাস করাতে চাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য আমি দেখতে পাইনি। এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৯৩টি। প্রায় ১০টা আসনের ফলাফলের যথার্থতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল। (আনিসুজ্জামান, বিপুলা পৃথিবী, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৭০)

জোর করে নির্বাচনে জেতার প্রবণতা দিনে দিনে বেড়েছে। পরবর্তী প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে জোরজবরদস্তির ঘটনা পূর্ববর্তী রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন তো পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিই মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। নির্বাচনী ব্যবস্থা চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে।

[১০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টারে নাজমুল করিম স্মারক বক্তৃতা হিসেবে দেওয়া বক্তব্যের প্রথম কিস্তি।]

আগামীকাল: মোসাহেবদের বাড়বাড়ন্ত

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]