গবেষণার স্বাধীনতা, গবেষকের নিরাপত্তা

‘ভেজাল’ এ দেশে বহু আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। আমরা আসলে কী খাচ্ছি? আমাদের শিশুদের কী খাওয়াচ্ছি? খাওয়ার পানি থেকে শুরু করে কোন খাদ্যে ভেজাল নেই? শুধু রমজান মাসে ভেজালবিরোধী অভিযানের কথা শোনা যায়। সম্প্রতি বিভিন্ন কোম্পানির ৫২টি পণ্যকে ভেজাল পণ্য হিসেবে বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারের এমন ‘মৌসুমি’ অভিযানের বাইরে জনস্বার্থে বিভিন্ন গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা খাদ্যদ্রব্যের মান নিয়ে গবেষণা করছেন। এখন একটা হইচই চলছে দুধ নিয়ে একটি গবেষণার ফল প্রকাশের পর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও তাঁর সহযোগী গবেষকেরা দুধ নিয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করার পর তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের সচিব তাঁদের ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

অধ্যাপক ফারুকের গবেষক দল দেশের বাজার থেকে সাতটি ব্র্যান্ডের দুধের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে দুই দফায় পরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়োটিক ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি পায়। এসব গবেষণার ফল প্রকাশ করার পর অধ্যাপক ফারুক ও তাঁর সহযোগী গবেষকদের বিরুদ্ধে যেসব হুমকি উচ্চারণ করা
হচ্ছে, তা নিয়ে নাগরিক সমাজে প্রবল প্রতিবাদ হচ্ছে। এ নিয়ে যে পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে, তাতে অধ্যাপক ফারুক বিপন্ন বোধ করছেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।

শনিবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বাসভবনে অধ্যাপক ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুধের মানবিষয়ক জরিপের ফল নিয়ে কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও কোম্পানি মালিক যে ভাষা আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন, তাতে আমি বিপন্ন।’

প্রথমবার গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই অধ্যাপক ফারুকের ওপর নেমে আসে মামলার হুমকি, অসম্মানসহ নানা ধরনের কটূক্তি। বিষয়টি সংসদ আলোচনায় স্থান পায়। অধ্যাপক ফারুকের ওই গবেষণা সঠিক নয় দাবি করে ৯ জুলাই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ‘নিরাপদ তরল দুধ উৎপাদন’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিন বলেন, ‘গবেষণা প্রটোকল’ না মানায় তাঁর (অধ্যাপক ফারুক) বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশন নেওয়া হবে।

তবে এই লেখার মূল জায়গা অধ্যাপক ফারুককে নিয়ে নয়; বরং তাঁর গবেষণার ফলাফলকে কেন্দ্র করে যে ধরনের ক্ষমতার চর্চা প্রদর্শন হয়েছে, তার প্রতিবাদ করা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জগৎকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়ার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এ ঘটনার পর থেকে অনেক শিক্ষক-গবেষকের মধ্যে গবেষণাকর্ম সম্পর্কে দ্বিধা, নিরুৎসাহ এমনকি ভয়ও সৃষ্টি হতে পারে। ইতিমধ্যে সে রকম কিছু আলামত লক্ষ করা যাচ্ছে। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ফার্মেসি অনুষদের চারটি বিভাগের চার চেয়ারম্যান যৌথভাবে এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের গবেষণার ফলাফলের দায়দায়িত্ব তাঁদের নয়। অধ্যাপক ফারুক কিন্তু দাবি করেননি যে দুধ নিয়ে তাঁরা যে গবেষণা করেছেন, সেটি বিভাগীয় উদ্যোগে করা হয়েছে। সুতরাং বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের যৌথ বিবৃতিটি নিষ্প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন এভাবে তাঁদের ‘দায়দায়িত্ব’ অস্বীকার করার প্রয়োজন বোধ হলো, এমন প্রশ্ন উঠলে তার উত্তর আসতে পারে যে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হওয়ার পর।

আসলে এভাবে বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও অনেক হুমকি সত্ত্বেও অধ্যাপক ফারুক ও তাঁর গবেষক দল দুধ নিয়ে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলের বিষয়ে নিজেদের অবস্থানে অটল রয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, তবু সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিপত্তিশালী ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলোর এমন ভয়ভীতি প্রদর্শনের প্রবণতা আপত্তিকর। জনগণের স্বাস্থ্যের চেয়ে ‘গবেষণা প্রটোকল’ বড় নয়, আমাদের শিশুদের খাদ্যনিরাপত্তার চেয়ে বড় নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব জনস্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা, কায়েমি স্বার্থবাদী ব্যবসায়ী মহলের স্বার্থ রক্ষা করার দায়িত্ব নয়।

কোনো গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে একই বিষয়ে আরও গবেষণা করতে হয়। বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে খুব সহজে খারিজ করা যায় না। যাঁরা তা খারিজ করতে চাইবেন, তাঁদের কাছে উপযুক্ত গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত থাকতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের বিরাজমান মানদণ্ড, যন্ত্রপাতি বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান না রেখে কিসের ওপর ভিত্তি করে একজন সচিব একজন গবেষককে মামলার হুমকি দিতে পারেন, তা কোনোভাবেই পরিষ্কার হচ্ছে না। তাঁর হুমকি পুরো একাডেমিক জগৎকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তা করার পরিবর্তে ক্ষমতার দম্ভযুক্ত নিয়ন্ত্রণ-প্রবণতার ইঙ্গিতবাহী। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়; এর বিরুদ্ধে যথাযথভাবেই সোচ্চার প্রতিবাদ হচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল এই গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। বাজারে যেসব কোম্পানির দুধ বিক্রি হচ্ছে, যা আমরা খাচ্ছি এবং আমাদের শিশুদের খাওয়াচ্ছি, সেগুলোতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান আছে—এই গবেষণালব্ধ তথ্যের প্রতি মন্ত্রণালয়ের যদি আস্থা না থাকে, তাহলে তারা অন্য গবেষক দিয়ে সেগুলো পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তা না করে ক্ষমতার জোরে গবেষকদের ভয় দেখানো, মামলার হুমকি দেওয়া আপত্তিকর। সরকারের দায়িত্ব দুধ কোম্পানিগুলোকে নজরদারিতে রাখা, জনগণের জন্য মানসম্পন্ন দুধের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। উল্টোটা নয়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নীরবতা দুঃখজনক। শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে কাজ করার কথা থাকলেও শিক্ষক সমিতি ক্ষমতায় ঠেস দেওয়া, দলীয় পাটাতনিক কাঠামো নিয়েই আছে। শিক্ষক, গবেষকদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র—এগুলো রক্ষায় তাদের ভূমিকা এখন অনেকটাই ‘হুঁ-হাঁ’ কিংবা ‘দেখছি’, ‘দেখব’এর মধ্যেই জীবিত।

দুধ নিয়ে করা গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করাকে কেন্দ্র করে যে বিষয়গুলো ঘটছে, তা আসলে অনেক বিষয়কে সামনে সুস্পষ্টভাবে হাজির করছে। বিদ্যাজগতে রাষ্ট্রের নজরদারি, কর্তৃত্ব, ক্ষমতাচর্চার ধরন এবং সর্বোপরি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রুদ্ধ করার প্রবণতা বড়ই দুশ্চিন্তার বিষয়।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]