রাহুল বাদ, কংগ্রেস একজন অমিত শাহ খুঁজছে

রাহুল গান্ধী
রাহুল গান্ধী

কর্ণাটক, গোয়া, মহারাষ্ট্র, গুজরাটসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রতি কংগ্রেস সংগঠকেরা ব্যাপকভাবে দল ছাড়ছেন। প্রশ্ন উঠেছে, নেতারা যে দল ত্যাগ করছেন, সেই দলের প্রতি জনগণের আগ্রহ বোধ করার আর কোনো অবকাশ আছে কি? খোদ দলটির সভাপতিও পদত্যাগ করে বসে আছেন। চার পাতাজুড়ে সেই পদত্যাগের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। কিন্তু আসলেই কি ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায় কংগ্রেসের প্রয়োজন ফুরিয়েছে?

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বয়স এখন ১৩৪ বছর। এর মাঝে দলটি ৫৫ বছর দেশ পরিচালনা করেছে। কিন্তু সর্বশেষ দুটি জাতীয় নির্বাচনে নিদারুণভাবে হেরেছে তারা। ২০১৪ সালে ৫৪৩ আসনের লোকসভায় দলটি ৪২ আসন পায়। এবার পেল ৫২ আসন। পুরো আসনের দশ ভাগও নয় যা। রাহুল গান্ধী নিজেও একটি আসনে হেরেছেন। সর্বশেষ নির্বাচনে ১৩টি রাজ্যে ও ৫টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে দলটি কোনো আসনই পায়নি।

স্বভাবত ভেতর-বাইরের অনেকেরই ধারণা, এ দলের পক্ষে আর ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়—বিশেষ করে একটি পরিবারের কাছে নেতৃত্ব বন্ধক রেখে। বরং কংগ্রেসের প্রয়োজন অমিত শাহর মতো একজন নেতা, যিনি দলটিকে নতুন করে নির্বাচনী রসায়ন শেখাবেন। আগামী সপ্তাহেই হয়তো কংগ্রেস সে রকম একজন নেতা খুঁজে নেবে!

রাহুলের দৃঢ়তা ও কংগ্রেসের দ্বিধা
পরিস্থিতির দায়ভার কাঁধে নিয়ে রাহুল গান্ধী পদত্যাগ করেছেন প্রায় দুই সপ্তাহ হলো। কারণ, তাঁর পক্ষে আসলেই অমিত শাহ হওয়া সম্ভব নয়। হয়তো সে রকম কিছু হতেও চান না তিনি। তাঁর পদত্যাগকে প্রথমে শত্রু-মিত্র অনেকেই ‘নাটক’ হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন, বিশেষ করে প্রচারমাধ্যম। এখন সবাই মানছেন, রাহুল গতানুগতিক রাজনীতিবিদদের মতো নন। স্পষ্ট বোঝা যায়, রাহুলকে বুঝতে ভারতের রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের এখনো ঘাটতি আছে। পদত্যাগের ব্যাপারে দৃঢ়তা ইতিমধ্যে রাহুলের জনপ্রিয়তা সামান্য হলেও বাড়িয়েছে। মা বা বোন দলটির হাল ধরুক, সেটাও চাইছেন না তিনি।

রাহুলের পদত্যাগ ভারতজুড়ে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বাস্থ্যকর এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কথা উঠেছে, আদৌ কংগ্রেস নেহরু পরিবারের ছত্রচ্ছায়া ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, কিংবা পারা উচিত হবে কি না। কংগ্রেসের সংকট আদর্শ, নাকি ব্যক্তি নিয়ে? নেহরু-গান্ধীর ভাবাদর্শ থেকে ধর্ম ও জাতিবাদী আদর্শই কি কংগ্রেসের পুনর্জীবনের পথ?

দল হিসেবে কংগ্রেস মানেই নেহরু পরিবার, এতে কোনো সন্দেহ নেই। জওহরলাল নেহরুর জন্মের চার বছর আগে কংগ্রেসের জন্ম। কিন্তু এখনো প্রায় প্রতিদিন বিজেপি-আরএসএস পরিবার নেহরুকে আক্রমণ করে বক্তৃতা-বিবৃতি শুরু করে। এতে বোঝা যায়, ব্যক্তি নেহরুর প্রভাব কেবল কংগ্রেসে নয়, ভারতেই প্রবলভাবে রয়ে গেছে আজও।

নেহরু ও মোহন দাস গান্ধী কতটা বহুত্ববাদী ছিলেন, এ নিয়ে বুদ্ধিজীবী সমাজে ন্যায্য বিতর্ক আছে। কিন্তু এও মিথ্যা নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম প্রতীক এই দুই ব্যক্তি। সে কারণেই আরএসএস খুব সঠিকভাবে কংগ্রেসকে নেহরু-গান্ধীর মূল্যবোধ থেকে দূরে সরাতে চাইছে এবং কংগ্রেস সেই ফাঁদেই পা দিয়েছে।

নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপি যতবার বলেছে ‘কংগ্রেস একটা মুসলমানবান্ধব দল’, কংগ্রেসের বুড়ো বুড়ো নেতারা রাহুলকে ততবারই মন্দিরে মন্দিরে নিয়ে গেছেন সেই অপবাদ ঘোচাতে। কখনোই রাহুল বলে ওঠেননি, হ্যাঁ কংগ্রেস হিন্দুদের মতোই মুসলমান-খ্রিষ্টানদেরও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বিজেপি যখন ‘ভারতীয় জাতীয়তা’কে ‘হিন্দু জাতীয়তা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর, কংগ্রেসের তরফ থেকে তার পাল্টা শক্ত জবাব কমই দেওয়া হয় আজকাল।

পরিবারতন্ত্রের শেষ প্রজন্ম সোনিয়া এবং তাঁর দুই পুত্র-কন্যা খুব কমই গান্ধী ও নেহরুর মূল্যবোধকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছেন। বরং নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্ব মোদি-অমিত শাহ জুটিকে অনুসরণ করতে চেয়েছে। এভাবেই আরএসএস সফল। কারণ, তারা কেবল কংগ্রেসকেই হত্যা করতে চাইছে না, ভারতে ও দক্ষিণ এশিয়ায় উদারনৈতিক চিন্তারও কবর রচনা করতে চাইছে। আপাতত কংগ্রেসবান্ধবরা অনেকে সেই পরিকল্পনায় পা দিয়েই মনে করছেন, কংগ্রেসের উচিত গান্ধী পরিবারের বাইরের কাউকে দলটির সভাপতি করা, যাতে নেহরু ও গান্ধীর ‘দায়’ থেকে কংগ্রেসকে ‘রক্ষা’ করা যায়।

কংগ্রেস কি নিজের বিরুদ্ধে যাবে?
নির্বাচনে বারংবার পরাজয় কংগ্রেসের সামনে দুটি বিকল্প তৈরি করেছে: পুরোনো আদর্শবাদী রাজনীতিকে অধিক বিশ্বাস নিয়ে আঁকড়ে ধরা অথবা বিজেপির মতো করে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া। রাজ্যে রাজ্যে প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতারা দ্বিতীয় বিকল্পে আগ্রহী। যদিও কংগ্রেসের সংকটটা যতটা ব্যক্তিনির্ভর, তার চেয়ে বেশি আদর্শগত।

এটা সত্য, দক্ষিণ এশিয়ার পুরোনো এই দলটি অতিমাত্রায় একক পরিবারনির্ভর। দলে ব্যাপক সংস্কার অনিবার্য। বিশেষত এর ‘মালিকানা’ নেহরু পরিবারের পরিবর্তে জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। একটি পরিবারের প্রতি আনুগত্য ছাড়া কংগ্রেসের বহু ‘প্রভাবশালী’ নেতার কোনো জনভিত্তি আর অবশিষ্ট নেই। বাইরে গণতন্ত্রের জন্য অক্লান্ত সংগ্রাম করলেও দলটির অভ্যন্তরে সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধামাচাপা দেওয়া আছে।

কিন্তু এটা এক অবাস্তব ধারণা যে সোনিয়া-রাহুল-প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে তৃতীয় কেউ স্বাধীনভাবে আদৌ কংগ্রেস পরিচালনা করতে পারবেন। এ অসম্ভব। যদিও রাহুল পদত্যাগ করেন, সেই সম্ভাবনা যাচাই করে দেখতে বলছেন সবাইকে।

বাস্তবতা হলো, কংগ্রেসে এমন কোনো সংগঠক নেই যিনি নেহরু-গান্ধীর ছত্রচ্ছায়ার বাইরে এসে দলটিকে পুনর্গঠন করতে সক্ষম। এখনো সোনিয়া লোকসভায় দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং প্রিয়াঙ্কা একই দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন। এ পর্যায়ে যেটা বাস্তবসম্মত এবং চ্যালেঞ্জিং সেটা হলো, কংগ্রেসকে তার মূল ভাবাদর্শে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। আরেকজন অমিত শাহ না খুঁজে তার দরকার আরএসএসের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।

কংগ্রেসের স্মরণ করা উচিত, গান্ধী লবণ সত্যাগ্রহ করেছিলেন নির্বাচনের জন্য নয়। কিন্তু ওই রকম সত্যাগ্রহই তাঁর অনুসারী বাড়িয়েছিল এবং সেটাই ছিল কংগ্রেসের সদস্যশক্তি।

মোদি-অমিত শাহ জুটিকে মোকাবিলায় অনেকেই চাইছেন কংগ্রেসও আরএসএসের মতো ভাবাদর্শে সজ্জিত হয়ে উঠুক। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, দলটির জন্মের পর প্রথম তিনজন সভাপতির একজন ছিলেন হিন্দু, একজন পারসি এবং অপরজন মুসলমান। কেবল এই ঐতিহ্যই ভারতকে রক্ষা করতে পারে। কংগ্রেসকে প্রতিষ্ঠাকালীন ঐতিহ্যের পক্ষেই শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে।

কিন্তু আপাতত তা ঘটবে বলে মনে হয় না। কংগ্রেস রাহুলকে বাদ দিয়ে হয়তো একজন নতুন সভাপতি গ্রহণ করবে। কিন্তু আদর্শিক ও রণকৌশলগত দিক থেকে তাঁরা দোলাচলেই থাকবেন। এ অবস্থা কংগ্রেসের জন্য ক্ষতিকর হলেও রাহুল গান্ধীর সামনে একটা সুযোগ।

রাহুল কি গান্ধীকে অনুসরণ করবেন?
অনেকেই মনে করেন, বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার মোকাবিলায় সাংগঠনিক নানান বিচ্যুতি ও ভুল পদক্ষেপ সত্ত্বেও রাহুলের মাঝে বহুত্ববাদী এক ভারতের জন্য আন্তরিক আকুতি রয়েছে। এ অবস্থায় রাহুল চাইলে মোহন দাস গান্ধীর পথ বেছে নিতে পারেন। কংগ্রেসের প্রাতিষ্ঠানিক পদ বাদ দিয়ে বহুত্ববাদী উদারনৈতিক মূল্যবোধের পক্ষে ভারতের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াতে পারেন তিনি। ইতিহাস এ ক্ষেত্রে তাঁর পাশে আছে।

একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার এই উদাহরণও দিয়েছেন, ১৯২৪-এ মোহন দাস গান্ধীও কংগ্রেসের সাংগঠনিক সক্রিয়তা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এমনকি দলের প্রাথমিক সদস্যপদও। কিন্তু সেটা ছিল সংগঠন থেকে দূরে যাওয়া, দলের লক্ষ্য থেকে নয়। বিস্ময়করভাবে এর পরই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন ও কংগ্রেস, উভয় পরিসরে একচ্ছত্র প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। মোহন দাসের জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের একটি গণ্য করা হয় কংগ্রেসের ‘সভাপতি’র পদ ত্যাগ। সভাপতিত্বের বদলে সত্যাগ্রহের পথে নামার পরই কেবল তিনি সবার হয়ে গেলেন।

প্রায় এক শতাব্দী পর ভারতে আবার প্রবল সত্যাগ্রহ প্রয়োজন। কেবল ভারতই নয়, দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এ মুহূর্তে বহুত্ববাদী মূল্যবোধের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের মোকাবিলা চলছে। এর জন্য প্রয়োজন সর্বাত্মক এক রেনেসাঁস। রাহুল গান্ধী কোনোভাবেই এই লড়াই ত্যাগ করতে পারেন না। বরং এই যুদ্ধে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার তাঁকে প্রয়োজন। বহুত্ববাদকে রক্ষার মধ্য দিয়েই তিনি কংগ্রেসকেও রক্ষা করতে পারেন, অমিত শাহ হয়ে নয়।

কিছু মানুষের ক্ষমতার ক্ষুধা মেটানো রাজনীতির দায়। ওটা রাষ্ট্রনায়কদের পথ নয়। পরিবার আর দলতন্ত্রের বাইরে দাঁড়িয়েই রাহুল তাঁর আসল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেন। ভারত-আত্মার জন্য এ মুহূর্তে সেটাই জরুরি এবং সে লড়াইয়ে ভারত নিজের কাছেই প্রায় পরাজিত হতে বসেছে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।