দ্বিচারী এরশাদই জাতীয় রোল মডেল

এইচ এম এরশাদ।
এইচ এম এরশাদ।

এরশাদ বিড়াল ও তার মুখে ধরা ইঁদুরকে একসঙ্গে হাসাতে পারতেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে তো খেলেছেনই, ভারত-পাকিস্তানকেও একযোগে খুশি রেখেছেন। এটা তাঁর বিরাট যোগ্যতা। দোস্ত, দুশমন, ভক্ত—সবাইকেই তিনি আমোদিত ও আকর্ষিত রাখতেন। একসময়ের শত্রু আওয়ামী লীগকে মিত্র করেছেন, পরে বারবার সেই মিত্রের গদির সিঁড়ি হয়েছেন ১৯৯৬-এর নির্বাচনে, তারপরে ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনের সময়।

কাজগুলো কি তিনি আপন মুরোদে করেছেন? নাকি তিনি পরিস্থিতির প্রোডাক্ট, সুযোগচতুর এক রাজনৈতিক জুয়াড়ি?

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন যে এরশাদ প্রথমে নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করায় রাজি ছিলেন না। পরে ভেতর-বাইরের চাপে বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে উচ্ছেদ করে গদিতে বসেন। তার মানে এরশাদ সাহসী ছিলেন না, চালিয়াত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহস হারালেও বুদ্ধি হারাননি। সৈনিক মুক্তিযোদ্ধাদের মতো জীবনের ঝুঁকি নেননি। সাহস ও দেশপ্রেমে ভর করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নৈতিক জোর ও আদর্শিক প্রেরণা তাঁর ছিল না।

স্বাধীনতার পরের বিপরীত পরিস্থিতিতেও কোনো সুযোগ হারাননি। সেনাবাহিনীতে স্বমর্যাদায় পুনর্বাসিত হলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে পরিস্থিতি আবার ঘুরে গেলেও সেনাপ্রধান হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় তক্কে তক্কে থাকলেন। যেন এরশাদকে সুযোগ করে দিতেই জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। যদিও অভিযোগ, এই হত্যায় এরশাদের হাত পরিষ্কার না। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক এক দশক পরে মওকা পেয়ে এরশাদ রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন।

নব্বইয়ে তাঁর পতন হলেও অন্যান্য স্বৈরশাসকের মতো ধুলায় মিশলেন না। আবারও ভেতর-বাইরের খাতির পেয়ে ধন-প্রাণ দুই-ই বাঁচালেন। নতুন সুযোগ নিয়ে এল ১৯৯৬ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সাহায্য করার ইনাম হিসেবে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হলেন। এই করে এরশাদ হেরেও জিতলেন, গণতন্ত্র জিতেও হারল। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের বিজয়ের সুফল একটাই, মানুষ নির্ভয়ে এরশাদের সমালোচনা করত।

জনগণ যেমন তেমন নেতাই পায়। আমাদের মধ্যেই ছোট ছোট স্বৈরাচারের বাস। পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ থেকে রাষ্ট্রে তারাই কর্তা। এই ছোট স্বৈরাচারেরা এরশাদের মধ্যে তাদের মনের মানুষের দেখা পায়। তাই পতনের তিন দশক পরও এরশাদ প্রাসঙ্গিক থাকেন। মধ্যবিত্ত জীবনে একমুঠো স্বার্থের সঙ্গে এক চিমটি আদর্শবাদ আর এক চিমটি বিবেক লাগে। এরশাদ একমুঠো বাস্তব স্বার্থের সঙ্গে এক চিমটি ধর্ম আর এক চিমটি প্রেম মিশিয়ে যে ঘুঁটা দিলেন, সেটা অনেকেরই পছন্দ হলো।

এরশাদের আগের প্রধান দুই নেতাই আদর্শবাদের কথা, জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। এরশাদ আদর্শের জিগির এড়িয়ে বাস্তব স্বার্থের দড়িতে সামলে রেখেছেন বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণিকে। রাজনীতি থেকে আদর্শবাদ ও মতবাদ সরিয়ে নিয়ে এলেন উন্নয়নবাদ। এই উন্নয়নবাদের আফিমে আজও অনেকেই বুঁদ হয়ে আছেন। শাসনব্যবস্থার বিরাজনীতিকরণেরও সেটাই শুরু।

আগের নেতারা নিজেদের লার্জার দ্যান লাইফ ভাবমূর্তিতে স্থাপন করেছেন, এরশাদ নিজেকে সাজিয়েছেন ভুল-সঠিকে, পাপ-পুণ্যে, সাধু ও শয়তানে সাজানো পরিচিত চেহারায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা যেমন নরম-গরমে পরিচিত এক মানুষ, এরশাদ তেমনি সাধারণ ও সহজবোধ্য। মধ্যবিত্ত বিশ্বাস করে তাদেরই মতো একজনকে, যিনি সহজবোধ্য ও সুবিধাবাদী। আমাদের ভেতরের সুবিধাবাদের জয় হয়তো আমরা এরশাদের মধ্যেই দেখি।

বাংলাদেশের মানুষ বহু রকম দ্বিচারীপনা লালন করে। বহুরূপী এরশাদ এই জাতির খাসলত চিনেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিজীবন এবং রাজনীতিও দ্বিচারীপনায় ভরপুর। মধ্যবিত্তের অনেকের মতোই এরশাদের একদিকে ধর্ম, অন্যদিকে ভোগবাসনা; একদিকে সততার জয়গান, অন্যদিকে লকলকে লোভ; একদিকে শক্তের ভক্ত, অন্যদিকে নরমের যম; একদিকে দেশপ্রেম, অন্যদিকে বিদেশ পানে ধায় তার মন। এই কামরাঙা কবি একই সঙ্গে ভারত-পাকিস্তান ও আমেরিকার প্রিয় লোক। এই রাষ্ট্রধর্মবাদী শাসক বহুগামিতা ও যৌনাধুনিকতারও দিশারি পুরুষ। এরশাদ রাস্তাঘাট বানিয়েছেন, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করেছেন, কিন্তু কৃষি ও ভারী শিল্পের সম্ভাবনা রদ করে রেখেছেন। বন্যায় হাঁটুপানিতে সাঁতার কেটেছেন ঠিকই, কিন্তু ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের মতো সর্বনাশী নদীশাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। সাইকেলে চড়ে বেড়ালেও এরশাদের আমলেই ঋণ খেলাপ ও দুর্নীতি স্বাভাবিক বলে প্রতিষ্ঠা পায়। উত্তরের দরিদ্র এলাকার এই নেতার আমলে বাংলাদেশে দুর্নীতিজাত কোটিপতি শ্রেণির বিকাশ ঘটে।

এরশাদ ‘ছোট স্বৈরাচার’ হিসেবে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর একচেটিয়া স্বৈরাচারী মডেল আরও দুর্ধর্ষ হয়েছে। তাঁর আমলে সামরিক ক্যু হয়নি বটে, কিন্তু বিভিন্ন দলে রাজনৈতিক ক্যু ঘটিয়েছেন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ধারাকে ফাঁপা করে দিয়েছেন। লাখো তরুণের যৌবনকে অতিষ্ঠ করে নিজের যৌবন দীর্ঘায়িত করেছেন। ঠিকাদারনির্ভর এরশাদীয় উন্নয়ন মডেল এখনো ধনীকে অতি ধনী বানিয়ে যাচ্ছে।

এরশাদের সমর্থকেরা তাঁর এই দ্বিমুখী রূপের পুরোটা দেখতে চান না। গুণমুগ্ধরা গুণ দেখেন, বিরোধীরা দেখেন দোষ। দুইয়ে মিলে এরশাদ বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় সফল মানুষের রোল মডেল। এরশাদের মাপই আমাদের স্ট্যান্ডার্ড—কেউ তাঁর চাইতে বেশি, কেউ তাঁর চাইতে কম। কিন্তু সবাই কমবেশি তাঁরই মতো। এরশাদ কেবল অপার সম্ভাবনার আশির দশকই চুরি করেননি, জাতীয় চরিত্রের ওপর অমোচনীয় দাগও রেখে গেছেন। শাসক ও বিরোধী নেতা হিসেবে সমানতালে তিনি রাজনৈতিক দূষণ ছড়িয়ে গেছেন। এরশাদ দূরের কেউ নন, তিনি আমাদেরই লোক।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]