এই নগরে কেমন আছি

আপনি, আমি অথবা আমাদের সন্তানেরা কি নিরাপদ? বিকেলে খেলতে গেছে। সেই শিশুসন্তান যে খুন হয়ে যাবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে? বিশেষভাবে মেয়েশিশু ও নারীর জন্য দেশের বড় শহরগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

অথবা ধরুন, একটু খোলা মাঠ। অথবা বাসে চলাফেরার ব্যবস্থা? সবকিছুতেই কমবেশি সমস্যা। কী করা যায়?

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১১ ধারায় নিরাপদ ও টেকসই নগরের কথা বলা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে যেন আমাদের নগরগুলোতে সবার জন্য ভালোভাবে থাকার ব্যবস্থা হয়। যেকোনো প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষমতা অর্জন করে। যেন নিরাপদ হয়।

সরকার এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কাজ করছে। কিছু অগ্রগতি থাকলেও অনেক কাজ বাকি। আমাদের নগরগুলো যে সমস্যায় জর্জরিত, সেটা তো আমাদের প্রতিদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা।

নগর ব্যবস্থাপনার এই সব দিক নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলো দুটি গোলটেবিল বৈঠক করেছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, নারী, শিশু, বয়স্ক, প্রতিবন্ধীসহ সবার জন্য সবুজ উদ্যান করতে চাই। এটা অসম্ভব নয়। কিন্তু নগরকে বদলানোর প্রথম শর্ত মানুষকে বদলানো। অন্য কেউ তো মানুষকে বদলাতে পারবে না, যদি তিনি নিজে না বদলান। কলকাতার একটি টিভিকেন্দ্রে প্রায়ই শুনি একটি আহ্বান। ‘চলো চলো চলো চলো চলো বদলাই।’ কথাটা আমাদের, বিশেষভাবে নগরবাসীর জন্য খুবই দরকার। মনমানসিকতা বদলাতে হবে। কোথাও একটু খালি জায়গা পেলেই সেটা প্রভাবশালীরা দখল করে নেন। তাহলে পার্ক আর সবুজ চত্বর কোথায় হবে? মেয়র সাহেব একেবারে ঠিক কথাটাই বলেছেন।

সেই সঙ্গে সেদিনের আলোচনায় বস্তিবাসীর দুর্দশার কথাও আসে। ওদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবেশ—সবকিছুতেই গন্ডগোল। সবার জন্য বসবাসযোগ্য জায়গা চাই। এখানে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠলে সব ভেস্তে যাবে। টেকসই উন্নয়নের মূলকথা অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা। এটা যদি চাই, তাহলে নগরের জন্য সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে। এটা সম্ভব। তবে উপযুক্ত পরিকল্পনা, সঠিক বাস্তবায়ন ও সবার সমবেত চেষ্টা চাই।

নারী ও শিশুবান্ধব নগরসেবা, ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন এখন সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে। যেকোনো মূল্যে নারী-শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো রকম শিথিলতা মেনে নেওয়া যায় না। এ বিষয়ে ইউনিসেফের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা বলেন। তিনি নারীর সুস্থতা, সম্মান ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ, সুস্থ ও কর্মক্ষম মা পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থ বিকাশের পূর্বশর্ত। তিনি আরেকটি চমৎকার ধারণা নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর কথা হলো, বিচ্ছিন্ন বা সাময়িক পদক্ষেপ নয়, একটি শিশুর মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে নিরাপদ জন্ম ও তারপর বড় হয়ে ওঠা এবং মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রাপ্য সেবা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা একে হয়তো খুব উচ্চাশা বলতে পারি। কিন্তু মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তাঁদের এলাকায় প্রতিটি সড়কে গুণমানে ও সহায়-সম্পদে ধন্য যত বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁদের শুধু একটু সদিচ্ছাই যথেষ্ট। তাঁদের সহযোগিতাসূচক অঙ্গুলিহেলন যে গ্রিন সিগন্যালের কাজ করবে, এরপর আর কিছু লাগে না।

তাহলে মূল কথাটি হলো নির্বাচিত মেয়র, জনপ্রতিনিধি এবং এলাকার মানুষ—এই তিনের একটি কার্যকর সমন্বয় থাকলে অনেক অসাধ্য সাধন করা যায়। সাধারণ মানুষ কিন্তু সব সময় ভালো কিছু করতে চায়। তার অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াই হলো নগর ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের মূল কাজ। এই শর্ত পূরণ করতে পারলে, মানুষের অসাধ্য বলে কিছু থাকে না।

সবুজ নগরীর কথা আমরা সবাই বলি আর ভাবি, এটা কীভাবে সম্ভব। এই ঢাকায় দেড়-দুই কোটি মানুষ থাকে। এখানে আবার সবুজ আসবে কোথা থেকে? কিন্তু এটা ভুল ধারণা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য, জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম বললেন, এই ঢাকায় ৩০টি পার্ক তৈরি করা হবে। পার্কগুলো শুধু সবুজই হবে না, চারপাশ থাকবে খোলা। চার দেয়ালে ঘেরাও করা থাকবে না। সবার অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করা হবে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। তিনি আরও আশ্বাস দেন, চলতি ও আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় টেকসই উন্নয়নের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম আরও উৎসাহব্যঞ্জক তথ্য দিয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বেশ কিছু জমি আছে, আবার অনেক জমি বেদখল হয়ে আছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ একর জমি পাওয়া যাবে। ওই জমি পার্কের জন্য। ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় পার্ক হবে।

গত সপ্তাহে বিজ্ঞান উৎসবে যোগদানের জন্য চট্টগ্রামে গিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থায় পড়ি। বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম নিউমার্কেট এলাকায় যেতে গাড়িতে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগেছে। এটা তো অচিন্তনীয়। কোনো ট্যাক্সিক্যাব যেতে চায় না। কারণ, রাস্তাঘাটের বেশির ভাগই বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। ওদিকে কনটেইনার ডিপো এলাকায় প্রচণ্ড যানজট। কনটেইনার যানগুলো এলোপাতাড়িভাবে রাস্তায় জট পাকিয়ে আছে। সবাই অসহায়। এর মধ্যে আবার রাস্তা মেরামত, কোথাও ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। সড়কে নৈরাজ্য আর কাকে বলে!

একই অবস্থা ঢাকা বা বড় বড় আরও কয়েকটি মহানগরে। এই অরাজক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। না হলে আমাদের উন্নয়নের সার্থকতা থাকবে না।

ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বড় মহানগরে এখন যানজট ও জলজট ভয়াবহ সমস্যা। এর একটা বিহিত করতেই হবে। হয়তো রাতারাতি হবে না। কিন্তু বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে সমাধান সম্ভব।

এই সময়ে এই নগরে আমরা একটু খারাপই আছি, দু-এক বছরের মধ্যে আরও ভালো থাকার স্বপ্ন নিয়ে।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]