মোসাহেবদের বাড়বাড়ন্ত

গণতন্ত্রের অবয়ব নিয়ে মতভেদ আছে। কতটুকু হলে গণতন্ত্র বলব আর কী না থাকলে বলব গণতন্ত্র নেই, এ নিয়ে সমাজে আছে অনেক বাহাস। কখনো মনে হয়, নির্বাচনই হলো গণতন্ত্রের চরম পরীক্ষা। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কিংবা সিন্ডিকেট নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। তবে যিনি বা যাঁরা নির্বাচিত হন, তিনি বা তাঁরাই যে সেরা, এটা কি সব সময় বলা যায়? শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ হয় না, শিক্ষক রাজনীতির জন্য ভোটার নিয়োগ হয়, জাতীয় সংসদেও এমনটি দেখা যাচ্ছে। সেখানে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা নির্বাচিত হন, তাঁদের আগে নিতে হয় দলের মনোনয়ন। দল তাঁকেই মনোনয়ন দেয়, যিনি অনুগত, আজ্ঞাবহ কিংবা অনুগ্রহজীবী। সমাজের সব ক্ষেত্রেই এই অনুগ্রহজীবী শ্রেণির রমরমা। আগে জাতীয় সংসদে আইন ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য ছিল। এটি স্বাধীন পেশা এবং এই পেশায় থেকে রাজনীতি করার সুযোগ ও সুবিধা ছিল। এখন আইন ব্যবসায়ীদের ছাপিয়ে ব্যবসায়ীদের অন্য গোষ্ঠীগুলোর বিস্তার ঘটেছে জাতীয় সংসদে। বলা হয়, সংসদ রাজনীতিবিদদের হাত ফসকে ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। ‘মনোনয়ন-বাণিজ্য’ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থাৎ টাকার জোরে বড় দলের টিকিট পাওয়া সহজতর হয়েছে। গণতন্ত্র এখন টাকার কাছে বন্দী। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পেশির জোর, মাস্তানতন্ত্র।

জাতীয় সংসদের সদস্য হতে পারলে অনেক অর্থ, বিত্ত ও প্রতিপত্তির মালিক হওয়া যায়। সে জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের মাস্তানতন্ত্র জেঁকে বসেছে। নির্বাচনপ্রত্যাশীরা কেবল প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীদের ওপরই চড়াও হচ্ছেন না, নিজের দলের প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও তাঁরা কোনো রকম ছাড় দিতে চান না। এ জন্য সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে খুন করতেও তাঁদের হাত কাঁপে না। অন্য দলের সঙ্গে এবং নিজ দলের ভেতরে বিরোধ এবং এর ফলে খুনখারাবি এখন যেন ডাল-ভাত। উদাহরণ হিসেবে এখানে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—দুটি বড় দলের হিসাব নেওয়া যেতে পারে।

বিএনপি শেষবার ক্ষমতায় ছিল ২০০১-০৬ সালে। ওই সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের বিবাদ লেগেই ছিল। দুই দলের ঝগড়ায় প্রতিপক্ষের হাতে ওই পাঁচ বছরে খুন হয়েছিলেন ১১৮ জন এবং জখম হয়েছিলেন ১১ হাজার ৪২৭ জন। ওই সময় বিএনপির মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছিল ২৮৪টি। এতে খুন হয়েছিলেন ৫৫ জন এবং আহত হয়েছিলেন ৬ হাজার ৬৮৪ জন। আওয়ামী লীগের লোকেরা যে সুবোধ বালকের মতো বসে ছিলেন, তা নয়। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কমপক্ষে ২৬৯ বার মারামারি করেছেন। খুন হয়েছেন ৩৭ জন এবং জখম হয়েছেন ৪ হাজার ৫৯৯ জন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দেশের হাল ধরল। খুনোখুনির সংখ্যা বেড়ে গেল। আওয়ামী লীগাররা নিজেরা নিজেদের ১২২ জনকে খুন করল ২০১৩ সাল অবধি। ওই পাঁচ বছরে বিএনপির লোকেরা নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মারল দলের ২৯ জনকে। এই দুই দলের লোকেরা একে অন্যের প্রাণ নিল ১৩১টি। (রওনক জাহান, পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৫, পৃ.১৬২-১৬৩ )

এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার। ক্ষমতার যে মধু, তার স্বাদ পেতে সবাই মরিয়া। ক্ষমতার মোহ মানুষকে অমানুষ বানায়। ক্ষমতার নাগাল পেতে কোটি কোটি টাকা লগ্নি হয়। মনোনয়নের জন্য লগ্নি-বাণিজ্য যেমন হয়, তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে পথ পরিষ্কার করতে ভাড়াটে খুনির জন্যও দেদার টাকা খরচ হয়। কয়েক বছর আগে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জের সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে প্রতিদ্বন্দ্বী এক রাজনীতিবিদ ভাড়াটে লোক দিয়ে খুন করিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে ফলাও করে এটা প্রচার হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জাতীয় পার্টির টিকিটে নির্বাচিত সাবেক সাংসদ আবদুল কাদের খান গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

একটি জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বলে আমরা যত দাবিই করি না কেন, আমাদের রাষ্ট্র এখনো জনগণের রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি। এখানে নাগরিকেরা রাষ্ট্র চালায় না, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিকদের। এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ভিত্তি হলো ঔপনিবেশিক আমলের আইনকানুন, যা এখনো বহাল আছে। আমাদের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থাটি শুধু সংরক্ষণই করেনি, কর্তৃত্বের মাত্রা বেড়েছে দিন দিন। এই কর্তৃত্ববাদের চূড়ান্ত প্রকাশ হলো হাল আমলের নির্বাচনব্যবস্থা। বলা যায়, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব চলে গেছে একটি মাফিয়া রাজনৈতিক বর্গের কাছে। এদের মধ্যে একাধিক দল আছে। দলগুলো মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্ফীত হচ্ছে মাফিয়া অর্থনীতি। এর একটি সাংস্কৃতিক দিকও আছে। তার ঝান্ডা তুলে ধরেছেন অনুগ্রহজীবী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতির এই তিন অশুভ শক্তির একটি আঁতাত এখন কোনো গোপন বিষয় নয়। সাধারণ মানুষ এদের হাতে জিম্মি। এই জিম্মিদশা কীভাবে কাটবে, সেটাই হলো কোটি টাকার প্রশ্ন।

রাজনীতি যখন প্রতিহিংসার শিকার হয় বা নেপথ্যে চলে যায়, তখন বুদ্ধিজীবীরা পথ দেখান—এ রকম একটি আবেগময় কথা চালু আছে। ১৯৬০-এর দশকজুড়ে আমরা এর কিছুটা বিচ্ছুরণ দেখেছিলাম। এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। দ্রোহের বদলে এখন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে পদ-পদবি-পদকের মোহ এত বেশি যে তাঁরা রাজনীতিবিদদের তথা রাজনৈতিক দলগুলোর মোসাহেবে পরিণত হয়েছেন। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই নিজেদের ভাসিয়েছেন গড্ডলিকাপ্রবাহে। সবাই ওপরে ওঠার মই খুঁজছেন। এ জন্য তাঁদের মধ্যেও চরম দ্বন্দ্ব ও দলাদলি।

বাঙালি কবি-সাহিত্যিকেরা ছোট মনের, হিংসুটে ও দলবাজ—এ বিষয়ে সন্দেহ করার লোক খুব কম। অনেক দেশেই বিদ্বজ্জনের মধ্যে উচ্ছিষ্টলোভীদের দেখা যায়। বাঙালিদের মধ্যে এই প্রবণতা সম্ভবত বেশি। এটি ভাবার আরেকটি কারণ হলো, আমরা চারপাশে তো বাঙালিদেরই দেখি। এর কারণ সাহিত্যগুণের চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, গোষ্ঠী পরিচয়, মাতব্বর লেখকদের চামচাগিরি লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকরী। অন্য সামাজিক কারণগুলোর মধ্যে আছে বিভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া কম জানা, বিশ্বদৃষ্টির অভাব, অনুকরণপ্রিয়তা এবং দাদাগিরি-মামাগিরির আধিপত্য। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত ঈর্ষা তো আছেই। বুদ্ধিজীবীদের অধঃপতনের আরেকটি কারণ বা অনুষঙ্গ হলো সামাজিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকা। আর কোনো দেশে সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা বাঙালিদের মতো এত গা বাঁচিয়ে চলেন না। (সজল বসু, বাঙালী জীবনে দলাদলি, সমাজ বীক্ষণ কেন্দ্র, কলকাতা, ২০১৪, পৃ.১১৪)। তাঁদের চাটুকারিতা কিংবা নির্লিপ্ততা কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির পিদিমের সলতেটা আরও উসকে দেয়।

[গত ১০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাজমুল করিম স্টাডি সেন্টারে নাজমুল করিম স্মারক বক্তৃতা হিসেবে দেওয়া বক্তব্যের দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি।]

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]