তালেবানের সঙ্গে একটি টেস্ট ম্যাচ

শান্তিচুক্তি ছাড়াই শেষ হয় দোহা আলোচন। ছবি: রয়টার্স
শান্তিচুক্তি ছাড়াই শেষ হয় দোহা আলোচন। ছবি: রয়টার্স

ব্রিটেনের মাঠে সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আফগানিস্তানের টিম সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তারা খুবই ভালো খেলেছে। কাতারের রাজধানী দোহার ‘মাঠে’ এ মাসেরই শুরুতে দেশটির অন্য দুটি টিম (আফগান সরকার ও তালেবান) ‘শান্তির রূপরেখা’ প্রণয়নে সম্মত হতে মুখোমুখি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের ‘খেলা’ মোটেও ভালো হয়নি।

আফগান সরকারের যে কর্মকর্তারা দোহা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেরা পর্যন্ত কাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন তা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন, কারণ আলোচনার টেবিলে তাঁদের প্রতিপক্ষে যাঁরা ছিলেন তাঁরা উন্মত্ত খুনিদের নেতা, যাঁরা আফগান সরকারকেই স্বীকার করেন না। মার্কিন মধ্যস্থতাকারী জালমে খলিলজাদের উপস্থিতিতে দুই দিনের বৈঠক শেষে উভয় পক্ষ যৌথ ঘোষণায় আটটি বিষয়ে একমত হওয়ার কথা বলেছে। জালমে খলিলজাদ উভয় পক্ষকে ‘কমন গ্রাউন্ড খোঁজার বিষয়ে’ ভূমিকা রাখায় অভিনন্দনও জানিয়েছেন।

দোহায় উভয় পক্ষ ‘বেসামরিক হতাহতের ঘটনা শূন্যে নামানো’র বিষয়ে একমত হয়েছে। কিন্তু তারা যখন বৈঠক করছিল, সে মুহূর্তেই তাদের ‘কমন গ্রাউন্ড’ আফগানিস্তানের মাটি তালেবানের উপর্যুপরি হামলায় রক্তাক্ত হয়েছে। তালেবান ১ জুলাই কাবুলের একটি সরকারি কম্পাউন্ডে হামলা চালিয়ে ৪০ জনের বেশি লোককে মেরে ফেলেছে। এর ছয় দিন পরই মধ্য গজনি প্রদেশে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে তারা কমপক্ষে এক ডজন মানুষ হত্যা করেছে। নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুনের ২৮ থেকে জুলাইয়ের ৪ তারিখ পর্যন্ত তালেবান হামলায় ২৬৪ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ৫৮ জন বেসরকারি লোক নিহত হয়েছেন। এই হামলা সহসাই বন্ধ হবে বলেও মনে হচ্ছে না।

উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘অস্ত্রের সঙ্গে অস্ত্রের লড়াইয়ের চেয়ে চোয়ালের সঙ্গে চোয়ালের লড়াই ভালো।’ কিন্তু তালেবান একই সঙ্গে অস্ত্র ও চোয়ালের লড়াই চালানোর অভিনব ‘শিল্প’ দেখাচ্ছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান যেভাবে ইসলামি শরিয়া শাসন জারি রেখেছিল, ঠিক একই ধরনের শাসনব্যবস্থাই যে তারা ফিরিয়ে আনতে চায়, তা নিয়ে তাদের কোনো রাখঢাক নেই।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর মার্কিন অভিযানে তালেবান শাসনের পতন ঘটে। কিন্তু তালেবান সরকারের পতন ঘটলেও আফগানিস্তানের ভেতরকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের যে ঝামেলা সোভিয়েত আমল থেকে ছিল, সে সমস্যা রয়েই গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ তুমুল পর্যায়ে চলে যায়। এর একটি পর্যায়ে গিয়ে তালেবান ক্ষমতা দখল করে। তারা প্রকাশ্যে পাথর নিক্ষেপে মানুষ মারা, হাত–পা কেটে দেওয়া, নারীশিক্ষা নিষিদ্ধ ইত্যাদি চালু করে। সিনেমা, টেলিভিশন ও সংগীত নিষিদ্ধ করা হয়। ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহায়তায় তালেবান গৃহযুদ্ধ থামিয়ে একধরনের শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল বটে, তবে সে শান্তি ছিল কবরের শান্তি।

নাইন–ইলেভেন হামলার এক মাস পরই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর অভিযানে তালেবান সরকার ধ্বংস হয়ে যায়। আশা ছিল, আমেরিকান সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পরও সেখানকার মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পাকিস্তানের মদদ নিয়ে তালেবান আবার সংগঠিত হয়েছে এবং দখলকারীদের কাছ থেকে অনেক এলাকা তারা আবার ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া পরাজয় মেনে নেওয়ার নামান্তর জেনেও যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করেছে। ওবামার পথ অনুসরণ করে ট্রাম্পও সেনা সরিয়ে আনার চেষ্টায় অবিচল আছেন। তিনি তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালানোর পক্ষে মত দিয়েছেন।

ভারত উদ্বেগের সঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় নজর রাখছে। পাকিস্তানি জঙ্গিদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৯৯ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান ছিনতাই করে কান্দাহারে নামিয়েছিল তালেবান সন্ত্রাসীরা। সেই সময় তালেবান সাধারণ ভারতীয় যাত্রীদের জিম্মি করে যে সন্ত্রাসীদের ছাড়িয়েছিল, তাঁদের দু–একজনও দোহা আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। এটি ভারতের জন্য মানসম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক যৌথ বাহিনীর নিরাপত্তার আশ্বাসে ভারত আফগানিস্তানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ২০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেছে। ভারতে একজন লোকও পাওয়া যাবে না, যিনি বিশ্বাস করেন আন্তর্জাতিক বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়াই আফগান সেনারা দেশটির নিরাপত্তা বজায় রাখতে পারবেন। এখন সেখান থেকে আন্তর্জাতিক বাহিনী সরে এলে ভারতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ভারত সব সময়ই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সেখানকার গণতন্ত্র ও সুশীল সমাজকে শক্তিশালী করার পক্ষে। সে কারণেই ক্রিকেটপাগল ভারত বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের সদম্ভ উপস্থিতিকে স্বাগত জানিয়েছে। এখন আফগানদের মনে রাখতে হবে তালেবান সরকার কিন্তু ক্রিকেট খেলাও নিষিদ্ধ করেছিল।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী